লুটিয়ে পড়েছিল তারা— শরীরে নয়, আত্মায়!"
✍️ মাহাতাব আকন্দ
رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ، وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونِ، الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، وَسَلَامٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى، وَسَلَامٌ عَلَى مُحَمَّدٍ الَّذِي جَاءَ بِالْقُرْآنِ مُهَيْمِنًا۔
(হে আমার প্রতিপালক! আমি আশ্রয় চাই শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে, এবং আশ্রয় চাই যেন তারা আমার কাছে না আসে। সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সকল জগতের প্রতিপালক। শান্তি বর্ষিত হোক তাদের ওপর যারা হেদায়াতের পথে চলে, আর শান্তি সেই মুহাম্মদের ওপর, যিনি এসেছিলেন কুরআনকে মহিমান্বিত করে।)
বন্ধুগণ!
আজ আমরা এমন এক শব্দ নিয়ে আলোচনা করবো — যা শুধু শরীর নয়, আত্মাকেও কাঁপিয়ে তোলে।
শব্দটি — "খররু সুজ্জাদা" (خَرُّوا سُجَّدًا) —
অর্থাৎ “সিজদায় লুটিয়ে পড়া।”
কিন্তু প্রশ্ন হলো — তারা কিসে কিভাবে লুটিয়ে পড়েছিল?
মাটিতে? নাকি সত্যের কাছে?
চোখের পানিতে? নাকি আত্মার নততায়?
বন্ধুগণ!
আল্লাহ বলেন সুরা মরিয়ম (১৯:৫৮)-এ —
"إِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ آيَاتُ الرَّحْمَٰنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا"
অর্থ: “যখন তাদের কাছে দয়াময়ের আয়াত পাঠ করা হতো, তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ত এবং কান্না করত।”
তুমি কি ভেবেছো, তারা সত্যিই মাটিতে পড়ে গিয়েছিল?
না!
তারা লুটিয়ে পড়েছিল আত্মায়, নত হয়েছিল চেতনায়, কেঁদেছিল হৃদয়ে।
তাদের চোখের অশ্রু ছিল আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের প্রতীক।
তাদের সিজদা ছিল “হে আল্লাহ! আমরা মেনে নিলাম”— এই অঙ্গীকারের নাম।
বন্ধুগণ!
এই আয়াত শুধু এক দৃশ্য না — এটি এক বিপ্লবের মুহূর্ত।
যেখানে নবী, রসূল, সৎকর্মশীলেরা শুনছিলেন রহমানের আয়াত,
আর তাদের অন্তর যেন ছিন্নভিন্ন হচ্ছিল সত্যের আলোর তাপে।
তাদের অহংকার গলছিল,
তাদের চিন্তা পুড়ছিল,
তাদের আত্মা কাঁদছিল।
এটাই “খররু”—
যেখানে শরীর নয়, আত্মা পড়ে যায় বিনয় ও উপলব্ধির সাগরে।
বন্ধুগণ!
একবার চিন্তা করো— যদি “সিজদায় লুটিয়ে পড়া” মানে শুধুই শারীরিক মাটিতে পড়া হতো,
তাহলে কি ফেরেশতারা আদমকে সিজদা করেছিল শরীর ঝুঁকিয়ে?
না, তারা ঝুঁকেছিল আজ্ঞাপালনে।
আল্লাহর হুকুম তারা মেনে নিয়েছিল আদমের মর্যাদায়।
তাদের সিজদা ছিল আজ্ঞাবহতা, স্বীকৃতি, বিনয়।
তাদের মাটি স্পর্শ করার দরকার হয়নি, কারণ সিজদা মানে শরীরের নয়, আত্মার নতি।
বন্ধুগণ!
“খররু” শব্দটি এসেছে “খারّরা” ধাতু থেকে, যার মানে— ধপ করে পড়ে যাওয়া, চমকে নত হওয়া।
এটা শারীরিক পড়া নয়, বরং এমন এক মানসিক ধাক্কা,
যেখানে আত্মা চিৎকার করে ওঠে—
“হে আল্লাহ! আমি বুঝেছি, বুঝতে পেরেছি, আমি মেনে নিয়েছি!”
যে মানুষ সত্যকে শোনে, আর তার অহংকার গলে যায়,
যে মানুষ কুরআনের আয়াত শুনে কান্না ধরে রাখতে পারে না,
সে-ই আসলে “সিজদায় লুটিয়ে পড়ে”—
যেমন বলেছিলেন আল্লাহ,
“যখন রহমানের আয়াত পাঠ করা হয়, তারা সিজদায় পড়ে ও কাঁদে।”
বন্ধুগণ!
এই “খররু” হচ্ছে মানুষের ভেতরের যুদ্ধের সমাপ্তি।
এটা অহংকারের পতন,
এটা হৃদয়ের নতি,
এটা সেই মুহূর্ত, যখন মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ বলে ওঠে—
“এটাই সত্য!”
তুমি কি ভেবেছো, নবীগণ এমনভাবে পড়ে যেতেন মাটিতে প্রতিবার কুরআন শুনে?
না, তারা অন্তরে লুটিয়ে পড়তেন —
তাদের চোখ ভিজে উঠত, আত্মা নত হতো,
তারা বলতেন— “আমরা শুনেছি এবং মান্য করেছি।”
বন্ধুগণ!
আল্লাহ আরেক জায়গায় বলেন —
سورة السجدة (৩২:১৫)
"إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِآيَاتِنَا الَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِهَا خَرُّوا سُجَّدًا"
অর্থ: “আমাদের আয়াতের প্রতি কেবল তারাই ঈমান আনে, যাদের কাছে তা স্মরণ করানো হলে তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে।” (সুরা সাজদা ৩২ঃ১৫)
দেখো! এখানে ঈমানের চাবিকাঠি হলো — “সিজদায় লুটিয়ে পড়া।”
কিন্তু এখনে আল্লাহ কি বলেছেন যে,— তারা উঠাবসা করুক, আর রাকাত গুনুক?
না!
তিনি বললেন— যখন আল্লাহর আয়াত তাদের স্মরণ করানো হয়, তখন তারা নত হয়ে যায়।
অর্থাৎ সিজদা এখানে আত্মিক— চিন্তা, উপলব্ধি ও আত্মসমর্পণের প্রতীক।
বন্ধুগণ!
এমন এক সিজদা, যা দেখা যায় না,
কিন্তু অনুভব করা যায় হৃদয়ে,
যেখানে তুমি কাঁদো,
তোমার অহংকার ভেঙে পড়ে,
তোমার আত্মা বলে—
“হে আল্লাহ! আমি তোমার।”
এই সিজদা সেই বিনয়, যা আল্লাহর আয়াত শুনে জন্ম নেয়।
এই সিজদা সেই কাঁপন, যা সত্যের আলো ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের অন্ধকার।
বন্ধুগণ!
এখানে আমরা বুঝি — “খররু সুজ্জাদা” মানে হচ্ছে চেতনার সিজদা।
যেখানে মন নত হয়, চিন্তা গলে যায়,
সত্যকে মেনে নেওয়ার সাহস জন্ম নেয়।
নবীরা যখন রহমানের আয়াত শুনতেন, তারা মাটিতে পড়তেন না —
তারা ভেতরে পড়ে যেতেন সত্যের কাছে।
তাদের কান্না ছিল আত্মসমর্পণের কান্না,
তাদের সিজদা ছিল বিনয়ের সিজদা।
বন্ধুগণ!
এক মুহূর্ত চিন্তা করো—
যদি সিজদা মানে শুধু “শরীর নত করা” হয়,
তাহলে পাহাড়, নদনদী, গাছপালা কিভাবে সিজদা করে?
পাহাড় কি মাটিতে পড়ে যায়? না।
তারা পড়ে আল্লাহর প্রশংসায়, তারা সাড়া দেয় সৃষ্টিকর্তার আহ্বানে।
তাদের সিজদা মানে— প্রকৃতির সমগ্র অস্তিত্বের আত্মসমর্পণ।
তারা পড়ে তাদের অবস্থানেই—
তাদের কণ্ঠ, তাদের স্পন্দন, তাদের ভারসাম্য— সবকিছুতেই আছে আল্লাহর প্রশংসা ও সিজদা।
বন্ধুগণ!
এই সিজদা কেবল নামাজের নিয়ম নয়,
এটা এক আত্মিক অভিজ্ঞতা, এক অভ্যন্তরীণ বিপ্লব।
যেখানে মানুষ নিজের ভেতরের শয়তানকে হারিয়ে দেয়,
যেখানে চিন্তা মুক্ত হয়,
যেখানে সে বলে—
“আমি নতি স্বীকার করছি আল্লাহর সামনে।”
বন্ধুগণ!
আজ তোমরা সিজদাকে বানিয়ে ফেলেছো কায়দা-কানুনের খেলায়।
কে কবে মাথা রাখবে, কে কয়বার পড়বে, কোন দিক ঘুরে পড়বে—
এসব নিয়ে লড়াই করছো,
কিন্তু সেই সিজদার অর্থ হারিয়ে ফেলেছো—
যেটা একসময় নবীদের হৃদয়ে আগুন জ্বেলেছিলো।
তোমরা রাকাত গোনো, কিন্তু হৃদয়ের আত্মসমর্পণ গোনো না।
তোমরা মুখে দোয়া পড়ো, কিন্তু মনে আলো জ্বালো না।
তোমরা মাটিতে মাথা রাখো, কিন্তু হৃদয় রাখো না আল্লাহর কাছে।
এই হলো আজকের উম্মতের সিজদা —
শরীরে আছে, কিন্তু আত্মায় নেই।
বন্ধুগণ!
আল্লাহর কাছে মূল্যবান হলো সেই সিজদা,
যেখানে অহং ভেঙে পড়ে,
যেখানে হৃদয় কাঁদে,
যেখানে মানুষ সত্যকে মেনে নেয়।
এই সিজদা কোনো মাটির নয়— এটা মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের।
এই সিজদায় নেই শরীরের প্রদর্শন,
এই সিজদায় আছে আত্মার আত্মসমর্পণ।
বন্ধুগণ!
সুরা মরিয়ম ১৯:৫৮ আয়াতে যখন আল্লাহ বললেন—
“তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ল এবং কান্না করল,”
সেটা ছিল এমন এক মুহূর্ত,
যখন তাদের হৃদয় সত্যের সামনে ভেঙে গিয়েছিল,
তারা বুঝেছিল—
এ পৃথিবীর সব অহংকার, ক্ষমতা, রাজত্ব, দল-মাযহাব—
সবই বৃথা, যদি আল্লাহর আয়াত না মানা হয়।
তারা কেঁদেছিল, কারণ তাদের আত্মা জেগে উঠেছিল।
তারা লুটিয়ে পড়েছিল, কারণ তারা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি।
তারা সিজদা করেছিল, কারণ তারা বুঝে ফেলেছিল সত্য।
বন্ধুগণ!
এই “লুটিয়ে পড়া” মানে হলো—
সত্যের মুখোমুখি হয়ে আত্মার ভেঙে পড়া।
যেমন বজ্রপাতের সামনে গাছ ভেঙে পড়ে,
তেমনি কুরআনের আলো যখন হৃদয়ে পড়ে,
মানুষের অহংকার ভেঙে যায়,
সে নত হয়, কেঁদে ফেলে।
এটাই “খররু”—
শরীরের নয়, চেতনার পতন;
মাটির নয়, হৃদয়ের নতি;
অবমাননার নয়, বিনয়ের ঘোষণা।
বন্ধুগণ!
যে জাতি কুরআনের সামনে এমনভাবে নত হতে পারে,
তারা পৃথিবীর কোনো শক্তির সামনে নত হয় না।
কিন্তু যে জাতি কুরআনের সামনে শুধু রীতিতে নত হয়,
তার হৃদয় কখনো জাগে না।
যারা হতে পারেনা "ফ্রেন্ডস অফ কুরআন"
তারা কখনো সত্যের আলো পায়না।
তারা মাটিতে পড়ে, কিন্তু আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না।
কারণ তাদের সিজদায় নেই উপলব্ধি, নেই কান্না, নেই বিনয়।
বন্ধুগণ!
আজ যদি তুমি কুরআনের আয়াত শুনে কাঁদতে না পারো,
তাহলে বুঝে নাও— তোমার সিজদা এখনো হয়নি।
আজ যদি তোমার হৃদয় কেঁপে না ওঠে,
তাহলে জানো— তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো অহংকারে।
সত্যিকারের সিজদা সেই মুহূর্ত,
যখন তোমার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে বিনয়ের কারণে,
যখন তুমি বলো— “হে আল্লাহ! আমি বুঝেছি, আমি ফিরে যাচ্ছি।”
বন্ধুগণ!
তুমি যদি নবীদের উত্তরসূরি হতে চাও,
তাহলে সেই সিজদা শিখো,
যা তাদের কাঁদিয়ে দিয়েছিল,
যা তাদের আত্মাকে নত করেছিল,
যা তাদের বানিয়েছিল রহমানের প্রিয়।
বন্ধুগণ!
আজ তোমারও সেই সিজদা দরকার—
যেখানে মাটি নয়, হৃদয় নত হয়;
যেখানে কান্না হয় অহংকারের মৃত্যুতে;
যেখানে আত্মা লুটিয়ে পড়ে আল্লাহর আয়াতের সামনে।
এই সিজদাই নবীদের সিজদা,
এই সিজদাই মুমিনদের কান্না,
এই সিজদাই সত্যিকারের বিনয়,
যার কোনো রাকাত নেই, কোনো ফিকহ নেই,
আছে শুধু এক আত্মিক চিৎকার—
“রব্বি, আমি মেনে নিয়েছি!”
শেষে বলি, বন্ধুগণ—
লুটিয়ে পড়া মানে দুর্বলতা নয়, শক্তি।
এটা সেই শক্তি, যা অহংকে হত্যা করে,
এটা সেই সিজদা, যা আল্লাহর কাছে মানুষকে করে প্রিয়।
তুমি যদি কুরআনের সামনে এমনভাবে লুটিয়ে পড়তে পারো,
তবে তুমি দাঁড়িয়ে গেছো মানবতার শিখরে।
কারণ যারা কুরআনের সামনে লুটিয়ে পড়ে— তারা আর কোনো ক্ষমতার সামনে মাথা নোয়ায় না!
0 Comments