Subscribe Us

কুরআনের বিয়ে বনাম প্রচলিত বিয়ে


 কুরআনের বিয়ে বনাম প্রচলিত বিয়ে

লিখকঃ- মাহাতাব আকন্দ

رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ، وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونِ، الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، وَسَلَامٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى، وَسَلَامٌ عَلَى مُحَمَّدٍ الَّذِي جَاءَ بِالْقُرْآنِ مُهَيْمِنًا

বন্ধুগণ!
আজ আমি এমন এক বিষয় নিয়ে কথা বলবো, যেটিকে সমাজ ধর্মের নামে এমনভাবে শিকলে বেঁধেছে যে, সহজকে কঠিন করা হয়েছে, সত্যকে আড়াল করে মিথ্যা দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেই বিষয়টি হলো—বিবাহ। হ্যাঁ, কুরআনের বিবাহ বনাম প্রচলিত বিয়ে। কুরআন যেখানে বিবাহকে করেছে সহজ, কল্যাণকর, আর আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক সম্পর্কের স্বীকৃতি, সেখানে আমাদের সমাজ সেটাকে বানিয়েছে মোল্লাদের বাণিজ্য, কাজিদের অফিস, আনুষ্ঠানিকতার কারাগার, আর একেকটা শোষণের শিকল।

বন্ধুগণ!
প্রথমেই বুঝতে হবে—বিবাহের উদ্দেশ্য কি? আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন:
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً
“তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে—তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তার কাছে শান্তি পাও; আর তিনি তোমাদের মধ্যে রেখেছেন ভালোবাসা ও দয়া।” (সূরা রূম ২১)

বন্ধুগণ!
এই আয়াতের মধ্যেই বিবাহের আসল উদ্দেশ্য খোলাখুলি বলা হয়েছে। বিবাহ মানে দয়া, ভালোবাসা, প্রশান্তি। বিবাহ মানে দুটি প্রাণের একে অপরের কাছে শান্তি খুঁজে পাওয়া। কিন্তু সমাজের বিবাহ আজ কি? সমাজে বিবাহ হয়ে গেছে প্রতিযোগিতা, দম্ভ, অর্থ আর লোভের ব্যবসা। এখানে শান্তি নেই, আছে আতঙ্ক। এখানে মমতা নেই, আছে পণ ও প্রদর্শনীর বোঝা। কুরআনের বিয়ে যেখানে স্বস্তির আশ্রয়, সমাজের বিয়ে সেখানে হয়ে গেছে দুঃস্বপ্নের ফাঁস।

বন্ধুগণ!
চলুন এবার দেখি কুরআনের বিয়ের শর্তগুলো কী কী। প্রথম শর্ত হলো—উভয়ের স্বাধীন সম্মতি। আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসা আয়াত ১৯-এ বলেছেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَرِثُوا النِّسَاءَ كَرْهًا
“হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে, তোমরা নারীদের জোরপূর্বক উত্তরাধিকারসূত্রে গ্রহণ করবে।”

বন্ধুগণ!
এই আয়াত প্রমাণ করে, নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বিয়ে বৈধ নয়। বিবাহ মানে স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি, ভালোবাসার স্বীকৃতি। কিন্তু সমাজ কী করে? সমাজ বলে—অভিভাবক ঠিক করে দেবে, মেয়ের মুখ বন্ধ থাকলেই সম্মতি ধরে নিতে হবে। অথচ আল্লাহ বলছেন, নারীর সম্মতি ছাড়া বিয়ে জোরপূর্বক, আর তা হারাম। বলুন তো, সমাজের নিয়ম মানা হবে, নাকি আল্লাহর আইন মানা হবে?

বন্ধুগণ!
দ্বিতীয় শর্ত হলো—মোহর। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً
“আর নারীদেরকে তাদের মোহর আনন্দের সাথে প্রদান করো।” (সূরা নিসা ৪)

বন্ধুগণ!
মোহর হচ্ছে নারীর অধিকার, সম্মান আর মর্যাদার প্রতীক। এটি ব্যবসা নয়, এটি দাসত্ব নয়। এটি ভালোবাসার প্রতীকী উপহার। কিন্তু সমাজ মোহর ভুলে গেছে, তার জায়গায় বসিয়েছে পণ। কুরআন বলছে—“মোহর দিয়ে সম্মান দাও।” সমাজ বলছে—“পণ দিয়ে অপমান করো।” আল্লাহর দ্বীনকে সমাজ বদলে দিয়েছে শয়তানের বাজারে।

বন্ধুগণ!
তৃতীয় শর্ত হলো—সাক্ষী। বিবাহ হলো সামাজিক চুক্তি। তাই আল্লাহ তায়ালা সাক্ষী রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। সূরা তালাক আয়াত ২-এ এসেছে:
وَأَشْهِدُوا ذَوَيْ عَدْلٍ مِنْكُمْ
“তোমাদের মধ্য থেকে দুইজন ন্যায়বান ব্যক্তিকে সাক্ষী করো।”

বন্ধুগণ!
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, বিবাহ বৈধ হতে হলে কমপক্ষে দুইজন ন্যায়বান সাক্ষী থাকতে হবে। এখানে কোনো গোপনীয়তা নেই, কোনো লুকোচুরি নেই। বিবাহ মানে প্রকাশ্য ঘোষণা। অথচ সমাজ কী করছে? তারা কখনো সাক্ষী ছাড়াই গোপনে বিয়ে করায়, আবার কখনো সাক্ষী রেখে কিন্তু নারীর সম্মতি ছাড়াই কারাগারে ঢুকিয়ে দেয়। এ দুটোই কুরআনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

বন্ধুগণ!
চতুর্থ শর্ত হলো—বৈধ সম্পর্ক নিশ্চিত করা। সূরা নিসা আয়াত ২৩-এ আল্লাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কের তালিকা দিয়েছেন। যেমন মা, বোন, খালা, ফুফু, দুধ-মা, দুধ-ভাই ইত্যাদি। এসব ছাড়া বাকি নারীদের সাথে বিবাহ বৈধ। কুরআনের এই আইনকে সমাজ কখনো মানে, কখনো ভেঙে ফেলে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী।

বন্ধুগণ!
এবার আসি মোল্লা, কাজী, খুতবার প্রশ্নে। কুরআন কোথায় বলেছে—“বিয়েতে অবশ্যই কাজী আসবে, খুতবা পড়বে, সিলমোহর দেবে”? কোথায় বলা আছে—“মঞ্চ সাজাতে হবে, লাখ টাকা খরচ করতে হবে”? এসব আল্লাহর কিতাবে নেই। কুরআনের বিধান হলো—সম্মতি, মোহর, সাক্ষী। এখানেই শেষ।

বন্ধুগণ!
মোল্লা বা কাজী আসা মানে কেবল সামাজিক সুবিধা। যেন একটা নিরপেক্ষ ব্যক্তি চুক্তি রেকর্ড রাখে। কিন্তু তাকে অপরিহার্য বানিয়ে দিয়েছে সমাজ। যেন তার অনুমতি ছাড়া বিয়ে শয়তানী কাজ! অথচ আল্লাহর কিতাবে কাজীর কোনো উল্লেখ নেই।

বন্ধুগণ!
খুতবার ব্যাপারেও একই কথা। কুরআন কোথায় বলেছে—“বিয়েতে খুতবা না পড়লে তা অবৈধ”? না। খুতবা ভালো উপদেশ হতে পারে, আল্লাহর নাম স্মরণ হতে পারে, কিন্তু এটা কোনো শর্ত নয়। আল্লাহর দ্বীনকে যারা জটিল করেছে, তারা খুতবা আর আনুষ্ঠানিকতাকে আবশ্যক বানিয়ে দিয়েছে।

বন্ধুগণ!
আমাদের সমাজে ইজাব-কবুল মানে হচ্ছে নির্দিষ্ট আরবী বাক্য উচ্চারণ করা। যেমন—“আমি কবুল করলাম।” কিন্তু কুরআনে এমন কোনো নির্দিষ্ট বাক্য নেই। মূল বিষয় হলো সম্মতি। তা কথায়, কাজে, কিংবা স্পষ্ট ইঙ্গিতে প্রকাশ পেলেই যথেষ্ট। ইজাব-কবুল মানে শুধু সম্মতি, কোনো যাদুকরী বাক্য নয়।

বন্ধুগণ!
এবার দেখি, সমাজ কীভাবে আল্লাহর সহজ দ্বীনকে জটিল করেছে। সমাজ বলছে—
• নির্দিষ্ট মোল্লা ছাড়া বিয়ে হবে না।
• খুতবা না পড়লে বিয়ে বাতিল।
• নির্দিষ্ট বাক্যে ইজাব-কবুল না হলে বিয়ে অবৈধ।
• বিপুল খরচ না করলে সমাজ মেনে নেবে না।
এসব কিছু কোথায় লেখা আছে কুরআনে? কোথাও না। এগুলো মানুষের বানানো বাড়তি শর্ত, যা আল্লাহর সহজ দ্বীনকে কঠিন করে তুলেছে।

বন্ধুগণ!
ফলাফল কী হয়েছে? সমাজে বিবাহ আজ এক আতঙ্ক। গরীব পরিবার মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়। মেয়ে অবিবাহিত থেকে অপমান সয়ে চলে। ছেলে অর্থের অভাবে বিয়ে করতে পারে না। ফলে অবৈধ সম্পর্ক ছড়িয়ে পড়ছে। পরিবার ভাঙছে, সমাজ অস্থির হচ্ছে। অথচ আল্লাহর কুরআনের সহজ নিয়ম মানলেই এসব বিপদ থাকতো না।

বন্ধুগণ!
আজকের সমাজে বিয়ে হয়ে গেছে এক প্রদর্শনী। মেয়ের বাবাকে নিঃস্ব করা, ছেলের পরিবারকে ধনী প্রমাণ করা। মঞ্চ সাজানো, হাজার মানুষের ভোজ, লাখ টাকার খরচ। অথচ কুরআন বলে—
“وَأَنْ تَعْفُوا أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى”
—“তোমরা যদি ছাড় দাও তবে তা তাকওয়ার কাছাকাছি।” (সূরা বাকারাহ ২৩৭)

বন্ধুগণ!
প্রশ্ন করি—এ কিসের ইসলাম? এ কিসের দ্বীন? এটা কি আল্লাহর দেয়া সহজ দ্বীন, নাকি মানুষের বানানো শৃঙ্খল? কুরআনের বিবাহ সহজ, সমাজের বিবাহ কঠিন। কুরআনের বিবাহ দয়ার প্রতীক, সমাজের বিবাহ শোষণের প্রতীক। কুরআনের বিবাহ নারীকে সম্মান দেয়, সমাজের বিবাহ নারীকে অপমান করে।

বন্ধুগণ!
আজ সময় এসেছে ফয়সালা করার। আমরা কি কুরআনের বিবাহ চাই, নাকি প্রচলিত বিয়ে চাই? আমরা কি শান্তি চাই, নাকি দুঃস্বপ্ন চাই? আমরা কি ভালোবাসা চাই, নাকি পণ আর ঋণের কারাগার চাই?

বন্ধুগণ!
আল্লাহর রাস্তা সবসময় সহজ। তিনি বলেছেন:
يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
“আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, কঠিনতা চান না।” (সূরা বাকারাহ ১৮৫)

বন্ধুগণ!
তাহলে কেন আমরা সহজকে কঠিন বানাচ্ছি? কেন আমরা কুরআনের সরল বিবাহ ছেড়ে শয়তানের কারাগারে ঢুকছি? আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য আইন মানা মানে শয়তানকে মানা। আর যারা শয়তানকে মানে, তারা পথভ্রষ্টদের দলে।

বন্ধুগণ!
আজ আমার আহ্বান—ফিরো কুরআনের বিবাহের দিকে। ফিরো আল্লাহর সহজ দ্বীনের দিকে। সমাজের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলো, পণের বাজার ধ্বংস করো, মোল্লা-কাজির ব্যবসা ভেঙে দাও। বলো—আমরা মানবো কেবল আল্লাহর আইন, মানবো কেবল কুরআনের সহজ বিবাহ।

উপসংহার
বন্ধুগণ!
আমরা দেখলাম—
• বিবাহের উদ্দেশ্য হলো শান্তি, মমতা ও দয়া।
• শর্ত হলো সম্মতি, মোহর, সাক্ষী, বৈধ সম্পর্ক।
• মোল্লা, কাজী, খুতবা এগুলো কুরআনের শর্ত নয়।
• সমাজের বাড়তি শর্তগুলোই আজ বিবাহকে দুঃস্বপ্ন বানিয়েছে।

অতএব, কুরআনের বিবাহ বনাম প্রচলিত বিয়ে—এখানে দ্বন্দ্ব পরিষ্কার। কুরআনের বিবাহ সহজ, শান্তির প্রতীক; প্রচলিত বিয়ে জটিল, কষ্টের প্রতীক। এখন পছন্দ আমাদের হাতে। আমরা কি আল্লাহর আইন মানবো, নাকি সমাজের শৃঙ্খলে দাসত্ব করবো?

Post a Comment

0 Comments