Subscribe Us

সূরা আল-আনকাবূত (২৯:৬৪) আয়াতের ব্যাখ্যা

 


সূরা আল-আনকাবূত (২৯:৬৪) আয়াতের ব্যাখ্যা 

লিখকঃ- মাহাতাব আকন্দ।

وَمَا هَٰذِهِ ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَآ إِلَّا لَهۡوٞ وَلَعِبٞۚ وَإِنَّ ٱلدَّارَ ٱلۡأٓخِرَةَ لَهِيَ ٱلۡحَيَوَانُۚ لَوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ

বাংলা অনুবাদ:
“এ দুনিয়ার জীবন তো কেবলই খেলা-তামাশা ও আমোদ-প্রমোদ ছাড়া কিছুই নয়। আর নিশ্চয়ই পরকালের আবাসই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত।” (২৯:৬৪)

এই আয়াত হলো এক চাবুক, যা আঘাত করে আমাদের ভোগে অন্ধ চোখে, আমাদের ভাড়াটে জীবনের অহংকারে, আমাদের দুনিয়ার মোহে আবদ্ধ হৃদয়ে। আল্লাহ এখানে স্পষ্ট করে বলেছেন, “وَمَا هَـٰذِهِ ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَآ إِلَّا لَهۡوٞ وَلَعِبٞ” — এ দুনিয়ার জীবন খেলনা ছাড়া কিছুই নয়, এক নাট্যমঞ্চ, যেখানে আমরা একদিন শিশুদের মতো খেলি, একদিন কিশোরদের মতো দৌড়াই, একদিন যুবকদের মতো লড়াই করি, আর শেষে বৃদ্ধদের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে মাটির নিচে চলে যাই। অথচ আমরা ভেবেছিলাম এই ক্ষণস্থায়ী সময়ই আমাদের সবকিছু, এই খেলাঘরই আমাদের রাজ্য, এই ভাড়া ঘরই আমাদের স্থায়ী ঠিকানা।

দুনিয়া হলো মরীচিকা, যেন মরুভূমির বুকে পিপাসার্তের চোখে ধরা জল, যা আসলে কেবল প্রতিফলন। তুমি যত দৌড়াও, জল পাবে না। তুমি যত কষ্ট করো, শেষ অবধি হাতে কেবল ধুলা জমবে। আল্লাহ তাই বলে দিলেন — “وَإِنَّ ٱلدَّارَ ٱلۡأٓخِرَةَ لَهِيَ ٱلۡحَيَوَانُ” — প্রকৃত জীবন, আসল জীবন, শাশ্বত জীবন কেবল আখেরাত। দুনিয়া ক্ষণিকের খেলা, আখেরাত অনন্তের বাস্তবতা। অথচ আমরা কেমন করে উল্টে দিই এই ঘোষণা! আমরা আখেরাতকে ভুলে যাই, দুনিয়াকে আঁকড়ে ধরি, মৃত্যুকে অস্বীকার করি, অথচ কবরের দ্বার প্রতিদিন খোলা হচ্ছে আমাদের চারপাশে।

তুমি কি ভেবেছো এই বাজার, এই রাজনীতি, এই সোনার গহনা, এই দালানকোঠা, এই গাড়ি-বাড়ি — এগুলো তোমার জন্য স্থায়ী? তোমার দেহ কি স্থায়ী? তোমার নিঃশ্বাস কি নিশ্চয়? তুমি কি গুনে গুনে নিজের শ্বাস নিয়েছ? প্রতিটি নিশ্বাস তো আল্লাহর হাতে, প্রতিটি রক্তকণার প্রবাহ তাঁর ইশারায়। অথচ মানুষ ভুলে যায়, মিথ্যা স্বপ্নের পেছনে ছুটে যায়। দুনিয়ার চাকচিক্য তাকে অন্ধ করে, সোনার ঝলকানি তাকে ধোকা দেয়, ক্ষমতার অহংকার তাকে বোকা বানায়।

এই দুনিয়ার খেলাঘরকে যদি তুমি সত্য ভেবো, তবে জেনে রাখো, আল্লাহ তোমাকে একদিন উল্টো করে দেবে। যেভাবে শিশুরা খেলনা ভাঙে, সেভাবেই কিয়ামতের দিন আল্লাহ এই মহাবিশ্বকে ভেঙে ছুড়ে ফেলবেন। সূর্যকে মুছে দেবেন, আকাশকে ছিঁড়ে ফেলবেন, পর্বতমালাকে উড়িয়ে দেবেন, আর মানুষকে খালি হাতে দাঁড় করাবেন। তখন তুমি বুঝবে — জীবন তো এটা ছিল না! তোমার যে জীবনের প্রতি আসক্তি, যে মর্যাদার জন্য তুমি মারামারি করেছ, যে ক্ষমতার জন্য রক্ত ঝরিয়েছ — সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।

তুমি কি জানো কেন আল্লাহ বললেন “إِلَّا لَهۡوٞ وَلَعِبٞ” — কেবল খেলা আর আমোদ? কারণ আমরা আসল লক্ষ্যকে ভুলে গিয়ে শিশুর মতো খেলায় মত্ত হয়ে যাই। তুমি যেমন শিশুকে খেলনা দাও, সে কাঁদা থামে, কিন্তু জানে না যে, খেলনার ভেতরে কিছুই নেই। তেমনি মানুষও দুনিয়ার খেলনা নিয়ে খুশি হয়, আর ভাবে এগুলো চিরদিন তার থাকবে। অথচ মৃত্যু যখন হঠাৎ এসে দাঁড়ায়, তখন বুঝে ফেলে সব ছিল প্রতারণা।

তুমি কি ভেবেছো আল্লাহর বানী শুধু গল্প? না, এ বানী বাস্তবতা। “وَإِنَّ ٱلدَّارَ ٱلۡأٓخِرَةَ لَهِيَ ٱلۡحَيَوَانُ” — আখেরাতই আসল জীবন। কবরের ভেতর তুমি প্রবেশ করার পরই বুঝবে জীবনের আসল পাঠ শুরু হলো। সেখানে আর নাটক নেই, আর অভিনয় নেই, আর মেকি হাসি নেই, আর কৃত্রিম পোশাক নেই। সেদিন শুধু সত্য থাকবে, নগ্ন বাস্তবতা থাকবে, আল্লাহর ন্যায়বিচার থাকবে।

এই আয়াত এক সতর্কবার্তা, আমাদের অহংকারের দুর্গে বজ্রাঘাত। যারা দুনিয়ার ভাড়াটে সিংহাসনে বসে নিজেদের রাজা ভাবে, তাদের জন্য এটা এক বিদ্রূপ। যারা দুনিয়ার ভোগে মত্ত, তাদের জন্য এটা এক আঘাত। আল্লাহ যেন বলছেন: ওহে মানুষ! তোমরা খেলছো, হাসছো, আনন্দ করছো, অথচ ভুলে গেছো যে মৃত্যু তোমাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। তোমাদের বাজার যখন জমজমাট, তোমাদের মঞ্চ যখন আলোকিত, তোমাদের গান যখন উচ্চস্বরে বাজছে — তখনই কবর খুঁড়ে রাখা হচ্ছে তোমাদের জন্য।

আজ যারা মনে করে তাদের জীবন খুব সুন্দর, তাদের পরিবারই সবকিছু, তাদের সন্তানই তাদের উত্তরাধিকার, তাদের ব্যবসাই চিরকাল থাকবে — তারা এক ভয়াবহ ভুল করছে। আল্লাহ বলছেন, এই দুনিয়ার জীবন কেবলই খেলা, কেবলই ছলনা। সত্যিকার জীবন শুরু হবে মৃত্যুর পর। তাই আজ যদি তুমি আখেরাতের জন্য প্রস্তুত না হও, তাহলে তুমি আসলে নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছো।

আজকের পৃথিবীতে আমরা দেখি — মানুষ টাকা কামানোর জন্য দিনরাত এক করে, মিথ্যা বলে, ধোঁকা দেয়, সুদ খায়, ঘুষ খায়, অশ্লীলতায় ডুবে যায়। অথচ সে ভাবে — এটাই জীবন! তার কাছে দুনিয়াই সব। কিন্তু সে বোঝে না, প্রতিটি কামাই করা টাকা, প্রতিটি অন্যায়ের সিদ্ধান্ত, প্রতিটি হারাম সুখ — কবরের ভেতরে বিষ হয়ে তার গায়ে কামড়াবে। আল্লাহর ঘোষণা স্পষ্ট — আখেরাত ছাড়া আর কোনো জীবন নেই।

কুরআন আমাদের মনে করিয়ে দেয় — এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া যেন একটি স্বপ্ন। তুমি যদি ঘুম থেকে উঠে দেখো স্বপ্নে পাওয়া ধনরত্ন নেই, তবে কি কষ্ট পাবে? না। তেমনি মৃত্যুর পর তুমি বুঝবে, দুনিয়ার ধনরত্ন কিছুই ছিল না। সত্য হলো — আল্লাহর বানী, তাঁর আইন, তাঁর আখেরাত।

আজ যারা নিজেদের প্রভাবশালী মনে করে, তাদের গাড়ি বহরে চলে, মানুষ সামনে মাথা নোয়ায় — তারা আসলে নিজের ধ্বংসের পথে যাচ্ছে। দুনিয়ার রাজত্ব কেবল এক নাটক, আসল বিচার মঞ্চ হবে আখেরাতে। সেখানে টাকা চলবে না, ক্ষমতা কাজ করবে না, পরিচিতি কাজে আসবে না। কেবল আল্লাহর কাছে জমা দেওয়া আমলনামাই তখন রক্ষা করবে।

এই আয়াতের শিক্ষা হলো — দুনিয়ার মোহ থেকে সরে দাঁড়াও, আল্লাহর পথে ফিরে এসো। মৃত্যুর আগে জেগে ওঠো। আজকের দুনিয়ায় আমরা যদি না বুঝি, তাহলে মৃত্যুর পর ওপারে গিয়ে বুঝতে হবে, তখন আর কোনো লাভ হবে না। তাই এখনো সময় আছে। দুনিয়ার এই খেলাঘর ছেড়ে দাও, আখেরাতের জীবনের জন্য প্রস্তুত হও।



Post a Comment

0 Comments