Subscribe Us

সুরা আন্-নামল (২৭:৮২) আয়াতের ব্যাক্ষা।


সুরা আন্-নামল (২৭:৮২) আয়াতের ব্যাক্ষা।

লিখকঃ- মাহাতাব আকন্দ 


আরবি আয়াত:

وَإِذَا وَقَعَ ٱلۡقَوۡلُ عَلَيۡهِمۡ أَخۡرَجۡنَا لَهُمۡ دَآبَّةٗ مِّنَ ٱلۡأَرۡضِ تُكَلِّمُهُمۡ أَنَّ ٱلنَّاسَ كَانُواْ بِـَٔايَٰتِنَا لَا يُوقِنُونَ

পৃথিবীর ইতিহাস একটাই সত্য বারবার ঘোষণা করে—মানুষ যত বড়াই করুক, যত জ্ঞান অর্জন করুক, যত সভ্যতা গড়ে তুলুক, সত্য অস্বীকার করলে তার পতন অনিবার্য। কুরআন ঘোষণা দেয়, “وَإِذَا وَقَعَ ٱلۡقَوۡلُ عَلَيۡهِمۡ”—যখন তাদের বিরুদ্ধে বাণী কার্যকর হবে। তখন আর কোনো পালাবার পথ থাকবে না। তখন ভূমি ফেটে বের হবে এক প্রাণী, “أَخۡرَجۡنَا لَهُمۡ دَآبَّةٗ مِّنَ ٱلۡأَرۡضِ”, যে মানুষের সাথে কথা বলবে। কল্পনা করুন সেই দৃশ্য—মানুষ, যে নিজেকে দুনিয়ার একমাত্র জ্ঞানী ভাবে, আজ মাটির প্রাণীর সামনে দাঁড়িয়ে শুনছে তার অপরাধের দলিল।

 এ আয়াতের প্রতিটি শব্দ আগুনের মতো জ্বলে। “وَقَعَ ٱلۡقَوۡلُ”—অর্থাৎ ঘোষণার বাস্তবায়ন। কতকাল ধরে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে, কতকাল ধরে নবীরা বলেছে—সাবধান হও, সীমা অতিক্রম কোরো না। কিন্তু মানুষ উপহাস করেছে। একসময় সেই ঘোষণা কার্যকর হবে। তখন আল্লাহ বলবেন—এখন আর ফিরবার সুযোগ নেই। এখন আর মিথ্যা সাজানো যাবে না। এখন বাস্তবের আগুন তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে।

 প্রাণী বের হবে ভূমি থেকে। “دَآبَّةٗ مِّنَ ٱلۡأَرۡضِ”—শব্দটাই যেন কাঁপিয়ে তোলে হৃদয়। ভূমি, যাকে আমরা প্রতিদিন পদদলিত করি, যেখান থেকে খাবার ফলাই, যেখানে দালানকোঠা দাঁড় করাই—সেই ভূমি একদিন আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। ভূমি বলবে—তুমি আয়াত অস্বীকার করেছ, তুমি অহংকার করেছ। ভূমি থেকে বের হওয়া প্রাণী যেন মানুষের কাছে আল্লাহর চূড়ান্ত দলিল।

 কল্পনা করুন, বিজ্ঞানীরা জড়ো হয়েছে, ক্যামেরা চলছে, সাংবাদিকেরা মাইক্রোফোন ধরেছে—এক প্রাণী মানুষের সাথে কথা বলছে। “تُكَلِّمُهُمۡ”—সে বলবে, “মানুষ আয়াত বিশ্বাস করেনি।” সেই মুহূর্তে সব সভ্যতার মুখোশ খুলে যাবে। বিজ্ঞানী বলবে—এটি হয়তো জেনেটিক মিউটেশন, দার্শনিক বলবে—এটি প্রতীকের ভাষা, কিন্তু প্রাণী বলবে—তোমাদের কুৎসিত অবিশ্বাসই আসল সত্য।

 আজ মানুষ প্রশ্ন তোলে—প্রাণী কথা বলবে কিভাবে? অথচ তারা দেখে যন্ত্র কথা বলে, মোবাইল কথা বলে, রোবট মানুষের মতো হাঁটে। মানুষ যখন নিজের হাতে মেশিন বানিয়ে তা দিয়ে কথা বলাতে পারে, আল্লাহ কি পারবেন না? সেই দিন মানুষ বুঝবে—আল্লাহর কুদরতকে ছোট করে দেখা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।

 এ আয়াত আমাদের শেখায়—ঈমান আনার সময় এখনই। কারণ আল্লাহ স্পষ্ট বলেছেন—শেষ সময়ের আলামত প্রকাশের পর যে ঈমান আনবে, তা আর কোনো কাজে আসবে না। সূরা আন’আম-এ আছে, সেই দিন যারা আগে ঈমান আনেনি, তাদের ঈমান কোনো কাজে লাগবে না। আর এই আয়াত—২৭:৮২—সেই দিনের এক ভয়াবহ ছবি এঁকে দিয়েছে।

 এ আয়াত ইতিহাসের আয়না। আদ জাতি বলেছিল—আমাদের চেয়ে শক্তিশালী কে আছে? সামুদ জাতি বলেছিল—আমরা পাহাড় কেটে ঘর বানাই, আমাদের কিছু হবে না। লূতের জাতি বলেছিল—আমরা নতুন নিয়ম বানাবো, আমাদের মর্জি চলবে। কিন্তু আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করার ফল তারা পেয়েছিল ধ্বংস হয়ে। আজকের মানুষও একই কথা বলছে—আমাদের বিজ্ঞান আছে, আমাদের পরমাণু বোমা আছে, আমাদের প্রযুক্তি আছে। কিন্তু সেই দিন ভূমি থেকে প্রাণী বের হবে, তখন বুঝবে—প্রযুক্তি শূন্য, আর আয়াতই সত্য।

 আমি দেখি আজকের দুনিয়া কুরআনের আয়াতকে অবহেলা করছে। কেউ বলে, কুরআন শুধু প্রাচীন বই, কেউ বলে এটি মানুষের লেখা। তারা বলে, আমাদের যুক্তি শক্তিশালী, কুরআনের বাণী দুর্বল। অথচ এই আয়াত এক বিদ্রোহী কণ্ঠে চিৎকার করে বলে—সেদিন প্রাণী তোমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, তুমি বিশ্বাস করোনি। তখন যুক্তি গলে যাবে আগুনে, অহংকার গুঁড়িয়ে যাবে মাটির সাথে।

 ভাবো তো—আল্লাহ কেন প্রাণীকে বেছে নিলেন? কারণ মানুষ ভাবত, প্রাণী তো নীরব, প্রাণী তো অধম। কিন্তু আল্লাহ দেখাবেন—তোমরা যারা নিজেদের প্রভু ভাবো, সেই প্রাণীই আজ তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে। সে বলবে—তোমরা আয়াত অস্বীকার করেছিলে। আজ তুমি পালাতে পারবে না।

 “أَنَّ ٱلنَّاسَ كَانُواْ بِـَٔايَٰتِنَا لَا يُوقِنُونَ”—মানুষ আয়াত বিশ্বাস করত না। এটাই মানুষের অপরাধের সারাংশ। তারা দেখেছে আকাশ-পাতাল, তারা দেখেছে দিন-রাত, তারা পড়েছে কুরআন, কিন্তু তারা বিশ্বাস করেনি। তারা মনে করেছে, এগুলো কাকতালীয়, এগুলো প্রকৃতির নিয়ম। অথচ প্রকৃতির স্রষ্টাকেই তারা অস্বীকার করেছে। সেই অস্বীকারের দলিল আজ প্রাণীর কণ্ঠে ফিরে আসবে।

 আমি বলি—এই আয়াত মানুষের অহংকারকে বিদ্রোহী কবিতার মতো ভেঙে চুরমার করে দেয়। এটি বলে—মানুষ, তুমি যত বড়ই হও না কেন, তুমি স্রষ্টার আয়াত ছাড়া কিছুই নও। তুমি যদি এখনই ফিরে না আসো, তবে কাল ভূমির প্রাণী তোমার অপরাধ মুখে তুলে ধরবে। তুমি লজ্জায় কাঁপবে, কিন্তু তবু পালাতে পারবে না।

 আজ যদি আমরা কুরআনকে অবহেলা করি, তবে কাল প্রাণী বলবে—তুমি কুরআন পড়েছিলে, কিন্তু বিশ্বাস করোনি। আজ যদি আমরা কেবল মুখে ঈমান আনি, কিন্তু কাজে না দেখাই, তবে কাল প্রাণী বলবে—তুমি শুধু বলেছিলে, কিন্তু মানোনি। আজ যদি আমরা আয়াত নিয়ে উপহাস করি, তবে কাল প্রাণী আমাদের নাম ধরে ডাকবে—তুমি ছিলে অস্বীকারকারীদের দলে।

 তাই আমি বলি—এই আয়াত হলো আগাম সতর্কবার্তা। এটি শুধু ভবিষ্যতের এক চিত্র নয়, এটি আজকের জন্যও একটি জ্বালা। এটি আমাদের বলে—এখনই আয়াতকে আঁকড়ে ধরো, এখনই কুরআনের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস আনো, এখনই অহংকার ছাড়ো। কারণ যখন প্রাণী বের হবে, তখন তোমার কান্না গলবে না, তোমার ঈমান আর কাজে লাগবে না।

 একদিন দুনিয়া স্তব্ধ হয়ে যাবে। দালানকোঠা ধসে পড়বে, অর্থনীতি ভেঙে যাবে, সভ্যতা থেমে যাবে। আর সেই দিন ভূমি থেকে প্রাণী বের হয়ে কথা বলবে। সেটাই হবে শেষ ঘোষণা। আর আজকের মানুষ, যে আয়াত নিয়ে ঠাট্টা করেছে, সে সেদিন মাথা নিচু করে শুনবে—তুমি আয়াত বিশ্বাস করোনি।

 আসুন আমরা এই আয়াতকে শুধু পড়েই শেষ না করি। আমরা এটিকে বিদ্রোহী শপথ বানাই। আমরা বলি—আমরা আয়াত অস্বীকার করব না, আমরা আয়াত উপহাস করব না। আমরা কুরআনকে আঁকড়ে ধরব, কারণ কুরআনই সত্য, আর আল্লাহর আয়াতই মুক্তির পথ। নইলে সেদিন ভূমির প্রাণী আমাদের মুখের সামনে আমাদের লজ্জা ঘোষণা করবে।


শেষকথা:
এ আয়াত এক বিদ্রোহী শ্লোগান, এক অগ্নিস্রোত, যা মানুষের অহংকারকে ভেঙে দেয়। “وَإِذَا وَقَعَ ٱلۡقَوۡلُ عَلَيۡهِمۡ”—যখন ঘোষণা কার্যকর হবে, তখন সব শেষ। আজ সুযোগ আছে, কাল নেই। তাই আয়াতকে অস্বীকার নয়, আঁকড়ে ধরো। নইলে সেদিন সেই প্রাণীর কণ্ঠেই তোমার নাম উচ্চারিত হবে—“তুমি আয়াত বিশ্বাস করোনি।”

Post a Comment

0 Comments