সুরা জুমুআর ৯ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা –
লিখকঃ- মাহাতাব আকন্দ।
আজ আমরা এমন এক আয়াতের সামনে দাঁড়িয়েছি, যে আয়াতকে দল ও মোল্লারা বেঁধে ফেলেছে সংকীর্ণ খাঁচায়। সেটি হলো— সুরা জুমুআ, আয়াত ৯। আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ
অর্থ: “হে ঈমানদারগণ! যখন জুমার দিনে সালাতের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন আল্লাহর স্মরণে ছুটে এসো এবং বেচাকেনা ছেড়ে দাও। যদি জান, তবে এটি তোমাদের জন্য উত্তম।”
ইয়াওমুল জুমআ মানে হল- একত্রিত হওয়ার দিন।
এই আয়াতকে মোল্লারা কী বানালো? তারা বলল— দেখো, আল্লাহ এখানে জুমার নামাজের হুকুম দিয়েছেন। তাই মুসলমানদের সপ্তাহে একবার অবশ্যই মসজিদে গিয়ে দুই খুতবা শোনা আর দুই রাকাত নামাজ পড়া ফরজ! না গেলে ঈমান অপূর্ণ, ইসলাম অসম্পূর্ণ!
কিন্তু বন্ধুগণ! আমি বলি— এ ব্যাখ্যা আল্লাহর কিতাবকে ছোট করা, সংকীর্ণ করা, আর মানুষকে দাসত্বের খাঁচায় বন্দি করা ছাড়া আর কিছু নয়।
চলুন গভীরে যাই। আল্লাহ কি বলেছেন “ইযা নূদিয়া লিস্সালাতি” অর্থাৎ যখন ডাকা হবে সালাতের জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো— সালাত মানে কি এখানে দুই রাকাত নামাজ? নাকি এক বিশাল জনসমাবেশ, যেখানে আল্লাহর স্মরণ, কুরআনের ঘোষণা, শপথ, সামাজিক অঙ্গীকার— সব একত্রিত হয়?
কুরআনের প্রতিটি আয়াতেই আল্লাহ বারবার বুঝিয়েছেন— সালাত মানে শুধু হাত বাঁধা, দাঁড়ানো, সিজদা নয়। বরং সালাত মানে সম্পর্ক, যোগাযোগ, শপথ, প্রতিশ্রুতি, এবং আল্লাহর স্মরণে প্রতিষ্ঠিত এক সমষ্টিগত জীবনব্যবস্থা।
আয়াতের মধ্যে এসেছে— ফাস‘আউ ইলা যিকরিল্লাহ— “আল্লাহর জিকিরে ছুটে আসো, আল্লাহ কুরআনকে জিকির বলেছেন।” কিন্তু বলুন তো— কই এখানে তো লেখা নাই: “ফাস‘আউ ইলা মাসজিদিল জুমু‘আ” (মসজিদে ছুটো), বা “ফাস‘আউ ইলা রাক‘আতাইন” (দুই রাকাত পড়ো)। আল্লাহ স্পষ্ট করে বলেছেন— আল্লাহর স্মরণের দিকে ছুটো।
এখানেই মোল্লারা জালিয়াতি করে— আল্লাহর জিকির বা স্মরণকে নামাজে সীমাবদ্ধ করেছে, কুরআনের ঘোষণা কেড়ে নিয়েছে, আর কুরআনকে লুকিয়ে রেখেছে আরবী খুতবার আড়ালে!
জুমার আসল উদ্দেশ্য কি? এটা কেবল মসজিদে গিয়ে হুজুরের আরবী ভাষার বুলিবাদ শোনা নয়। বরং— এটা ছিলো সামাজিক সমাবেশ, কেন্দ্রীয় বার্তা প্রচারের দিন, কুরআনের ঘোষণা ও আল্লাহর স্মরণ জোরে প্রচারের দিন। যেন গোটা সমাজ আল্লাহর দীনকে স্মরণে আনে, চুক্তি নবায়ন করে, নতুন শক্তি অর্জন করে।
কিন্তু আজ কী হলো?
আজ জুমা নামক অনুষ্ঠানটি দাঁড়িয়েছে—
• দুই রাকাত নামাজ,
• দুইটা খুতবা। (যেখানে কুরআনের কথা হওয়ার কথা ছিলো সেখানে কুরআন বাদ দিয়ে ঢুকানো হয়েছে- ছরছিনা পীরসাহেবের লিখা রুহানী খুতবা।, ঢুকানো হয়েছে আশরাফ আলী থানভীর খুতবাতুল আহকাম। যুগের পর যুগ ধরে মানুষ শুনে আছে আল্লাহর কিতাবের পরিবর্তে হুজুরের লিখিত কিতাব। মোল্লারা দিচ্ছে তার নেতৃত্ব।
আল্লাহর নামের স্মরণ হয় না, আল্লাহর কিতাব পড়া হয়না, হয় কেবল মোল্লাতন্ত্রের ক্ষমতা কায়েম।
আল্লাহ বলেছেন— ওয়াযারুল বাই‘— “বেচাকেনা ছেড়ে দাও।”
কেন? কারণ জুমার ডাকে সবাই যেন থেমে যায়, সবাই যেন একত্রিত হয়, আল্লাহর ঘোষণা শুনে, আর কুরআনের নির্দেশ মেনে নেয়। এটা ছিল একধরনের জরুরি জাতীয় ঘোষণা।
কিন্তু মোল্লারা এটাকে বানালো—
“শুধু বাজার বন্ধ করো, দোকান বন্ধ করো, দুই রাকাত পড়ে আবার খোলো।”
কিন্তু তারা ভুলে গেলো— এখানে উদ্দেশ্য হলো কুরআনের ঘোষণায় মনোযোগ, শুধু মসজিদের রাকাত নয়।
চলুন একটু কল্পনা করি— রাসূলের যুগে এই জুমার ডাকে কী হতো?
তখন তো কোনো মাইকে আজান ছিল না। বরং কোনো ঘোষক ঘোষণা করতো— এসো, আজ সমাবেশ আছে, আজ আল্লাহর ঘোষণা প্রচার হবে, আজ তোমাদের অঙ্গীকার নতুন করে স্মরণ করা হবে।
তখন মানুষ দৌড়ে আসতো। বাজারের কাজ থামাতো। চাষি তার খেত ছেড়ে আসতো। ব্যবসায়ী তার ব্যাবসা বন্ধ করতো।
কারণ— এটা ছিল আল্লাহর ঘোষণা শোনার আহ্বান।
এখন আসুন “সিজদা”র ধারণা স্মরণ করি। আমরা যদি সিজদা মানে নিই “মেনে নেওয়া”, তাহলে জুমার সমাবেশে মানুষের ভূমিকা কী দাঁড়ায়?
এটা দাঁড়ায়— মানুষ জুমায় এসে আল্লাহর কুরআন শুনে, তা মেনে নেয়, মাথা নত করে প্রতিশ্রুতি দেয়— “হে আল্লাহ! আমরা তোমার নির্দেশ মেনে চলব।”
কিন্তু বন্ধুগণ! আজ কি তাই হয়?
আজ মানুষ মসজিদে যায়, দুই রাকাত পড়ে, কি পড়লো আর কি বললো তার কিছুই বুঝে না, বের হয়ে আসে। খুতবার ভাষা আরবীতে, মানুষ কিছুই বোঝে না। আল্লাহর স্মরণ কোথায়? আল্লাহর বার্তা কোথায়? অঙ্গীকার কোথায়?
আমরা যদি আল্লাহর কিতাবের আসল মর্মার্থ ধরতে চাই, তাহলে জুমাকে শুধু নামাজে সীমাবদ্ধ করা চলবে না। বরং জুমা হলো—
• কুরআনের ঘোষণার দিন,
• আল্লাহর স্মরণে সমষ্টিগত প্রতিশ্রুতির দিন,
• সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি সংগঠনের দিন।
রাসূল -এর যুগে জুমা ছিলো— মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করার সমাবেশ। কিন্তু আজকের যুগে জুমা হলো— মোল্লাদের দাসত্বে লুটিয়ে পড়ার প্রতীক।
এই আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেন— যদি জান, তবে এটা তোমাদের জন্য উত্তম।
কিন্তু আমরা কী জানলাম?
আমরা তো শিখলাম— দুই রাকাতই যথেষ্ট! আল্লাহর স্মরণ হলো নামাজ শেষ করে বাজার খোলা!
না বন্ধুগণ! আল্লাহর কিতাব এভাবে সস্তা করা যায় না।
আল্লাহ বললেন— আল্লাহর স্মরণই সর্বোত্তম (সূরা আনকাবুত ৪৫)। কিন্তু আমরা বানালাম— রুটিন অনুষ্ঠান।
এখন প্রশ্ন করি—
কারা এবং কেন এই আয়াতকে নামাজে সীমাবদ্ধ করলো?
কারণ, তারা জানে যদি মানুষ বুঝে যে— জুমা মানে হলো কুরআনের ঘোষণা, সামাজিক চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, আর আল্লাহর দীন কায়েমের সমাবেশ— তাহলে মানুষ সরাসরি কুরআনের দিকে ফিরে যাবে। তখন হাদিসের দোকান, ফতোয়ার কারখানা, মাদরাসার বাজার— সব ধ্বংস হয়ে যাবে।
তাহলে আসুন, আমরা সুরা জুমার ৯ আয়াতকে নতুন আলোয় দেখি।
• এটা কোনো সংকীর্ণ নামাজের হুকুম নয়।
• এটা হলো এক সমাবেশের ডাক, আল্লাহর স্মরণে ফিরে আসার ডাক।
• এটা হলো সামাজিক বিপ্লবের ডাক।
• এটা হলো দুনিয়ার বেচাকেনা ছেড়ে, আল্লাহর নির্দেশ মানার আহ্বান।
আমি বলি— আমরা যদি সত্যিই কুরআনের আলো ধরতে চাই, তবে আমাদের জুমআকে সমৃদ্ধ করতে হবে। জুমা হবে— কুরআনভিত্তিক সমাবেশ, আল্লাহর স্মরণের ঘোষণা, মানুষকে আল্লাহর সাথে যোগাযোগের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার দিন।
তখনই আল্লাহর এ আয়াতের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
তখনই আমরা বুঝব— এটা আমাদের জন্য উত্তম।
আয়াতে এসেছে— فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ — “আল্লাহর স্মরণে ছুটো বা আল্লাহর কুরআনের জন্য ছোট।”
কিন্তু মোল্লারা এটাকে বানালো— শুধ দুই রাকাত নামাজের জন্য ছোটা।
কিন্তু আল্লাহ বলেননি যিকরুল্লাহ মানে = রাকাত।
আল্লাহ বারবার বলেছেন—
• أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ (রাআদ ২৮) — “নিঃসন্দেহে আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্ত হয়।”
• وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي (তাহা ১৪) — “আমার স্মরণের জন্য সালাত কায়েম করো।”
অর্থাৎ যিকরুল্লাহ মানেই কুরআনকে জীবনে স্মরণ রাখা, আল্লাহর বাণী শুনে তা মেনে নেওয়া। জুমার সমাবেশের উদ্দেশ্য ছিল সবার মনে কুরআন ঢুকানো, যাতে সমাজ আল্লাহভীরু হয়।
কিন্তু আজ কী হলো?
জুমা = নামাজ + খুতবা + বাজার বন্ধ।
কোথায় কুরআনের ঘোষণা? কোথায় আল্লাহর স্মরণ?
আল্লাহ বললেন— ওয়াযারুল বাই‘— “বেচাকেনা ছেড়ে দাও।”
এটা কি শুধু দোকানপাট বন্ধের জন্য? না!
বরং এটা ছিল প্রতীকী ঘোষণা— জুমার ডাকের সময় কোনো কিছুই যেনো আল্লাহর ঘোষণা থেকে মানুষকে ব্যস্ত না রাখে।
তুমি কৃষক হও, ব্যবসায়ী হও, শিক্ষক হও— সব কাজ ফেলে দাও। কারণ আজ আল্লাহর ঘোষণা হবে, সমাজের প্রতিশ্রুতি নবায়ন হবে।
কিন্তু আজ আমরা কী করি?
বাজার বন্ধ করি, মসজিদে যাই, দুই রাকাত পড়ি, আবার বাজার খুলি। উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়।
রাসূল (সা.)-এর সময়ে জুমআ ছিল— একটি রাজনৈতিক-সামাজিক সমাবেশ।
• সেখানে কুরআনের আয়াত প্রচার হতো।
• নতুন নির্দেশনা শোনানো হতো।
• মানুষ প্রতিশ্রুতি নিতো— আমরা আল্লাহর পথে চলবো।
• জরুরি জাতীয় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হতো।
অর্থাৎ জুমা ছিল উম্মাহর সাপ্তাহিক পার্লামেন্ট।
কিন্তু আজকের জুমা কী?
• একঘেয়ে খুতবা,
• মানুষ কিছুই বোঝে না,
• আল্লাহর বার্তা হারিয়ে যায়,
• শুধু মোল্লাদের ক্ষমতা টিকে থাকে।
আজ আমরা দেখি— জুমার নামাজের খুতবা অনেক সময় কুরআন নয়, বরং রাজনৈতিক বক্তব্য।
কোনো দেশে শাসকের প্রশংসা, আবার কোনো দেশে বিদ্বেষ ছড়ানো।
কুরআন গায়েব, মোল্লাতন্ত্র উপস্থিত।
এভাবেই জুমা পরিণত হয়েছে আল্লাহর স্মরণ থেকে শাসকের স্মরণে।
আল্লাহ বললেন— “জুমার আহ্বান শুনে দৌড়ে আসো।”
প্রশ্ন করি— যদি জুমা মানে কেবল দুই রাকাত নামাজ, তবে—
• কেন কুরআন বললো আল্লাহর স্মরণে আসো, নামাজে আসো বলেনি?
• কেন কুরআন বললো বেচাকেনা ছেড়ে দাও, অথচ নামাজ তো দিনে পাঁচবারই হয়?
• কেন বিশেষভাবে শুক্রবার নির্ধারণ করা হলো?
উত্তর সহজ— কারণ এটি কেবল নামাজ নয়, বরং সমাজের কেন্দ্রীয় সমাবেশ।
মোল্লারা ভয় পায় কুরআনের শক্তিকে।
তাই তারা যিকরুল্লাহকে শুধু নামাজে সীমাবদ্ধ করেছে।
কারণ যদি মানুষ সত্যিকারের যিকরুল্লাহ বোঝে, তবে—
• তারা কুরআনের বিপ্লবী শিক্ষা শুনবে,
• তারা সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে দাড়াবে,
• তারা আল্লাহর দীন কায়েম করবে।
কিন্তু মোল্লারা চায় না মানুষ জেগে উঠুক।
তাই তারা বললো— জুমা মানে শুধু নামাজ, আল্লাহর স্মরণ মানে শুধু আরবী খুতবা।
আসলে আল্লাহর জিকির মানে কী?
• অন্যায় ছেড়ে দেওয়া,
• ন্যায়ের পথে দাঁড়ানো,
• আল্লাহর কিতাব শুনে মাথা নত করা।
কিন্তু আজকের জিকিরের নামে কিহচ্ছে?
• শুধু ঝড়ের গতীতে নামাজ পড়া। নামাজ শেষে দোকান খোলা,
• আল্লাহর ঘোষণা কি, তার সাথে প্রতিশ্রুতি কি না বুঝেই চলে যাওয়া,
• জীবনে কোনো পরিবর্তন না আসা।
এটা কি আল্লাহ চেয়েছিলেন? না!
এটা হলো— মানুষের বানানো দাসত্বের খাঁচা।
আমরা যদি সত্যিই আল্লাহকে মানতে চাই, তবে আমাদের জুমআকে সমৃদ্ধ করতে হবে।
• জুমা শুধু নামাজ নয় জুমআ হবে কুরআনের ঘোষণা শোনার দিন।
• জুমআ হবে আল্লাহর দীন কায়েমের শপথের দিন।
• জুমআ হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার দিন।
• জুমআ হবে সামাজিক ন্যায়ের প্ল্যাটফর্ম।
যখন আমরা এমন জুমআ ফিরিয়ে আনবো— তখনই সুরা জুমার ৯ আয়াত সত্যি হবে।
তাহলে আমি বলি— আজ থেকে আমরা জুমাকে নতুন করে দেখি।
• এটা নামাজে সীমাবদ্ধ নয়।
• এটা আল্লাহর স্মরণে ছুটে যাওয়ার দিন।
• এটা সমাজে কুরআনকে জীবন্ত করার দিন।
মসজিদগুলোতে শুধু রাকাত নয়, কুরআনের ঘোষণা গর্জে উঠুক।
খুতবা হবে মানুষের ভাষায়, কুরআনের আয়াতে।
মানুষ শুনবে, বুঝবে, মেনে নেবে।
তাহলেই সত্যি হবে— ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ — “এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জান।”
0 Comments