Subscribe Us

ওহাবি ও সৌদির আতাতে! ইসলামি খিলাফত ধ্বংশ।

 


ওহাবি ও সৌদির আতাতে! ইসলামি খিলাফত ধ্বংশ।
আলোচকঃ- মাহাতাব আকন্দ

মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওহাব ও মুহাম্মদ ইবন সউদের আঁতাত – ইসলামী খেলাফতের পিঠে ছুরি?
বন্ধুগণ!
আজকের ভিডিওটি খুবি খুবি খুবি গুরুত্বপুর্ণ।  এজন্য চাই সর্বোচ্চ শেয়ার। প্রথমেই একটি লাইক দিন।
আজ আমরা এমন এক বেদনার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাবো, যা না জানলে মুসলিম উম্মাহর আজকের বিভক্তি ও দুর্দশা বুঝা যাবে না। তুমি যদি চোখ বন্ধ করে কেবল দুনিয়ায় ঘটে যাওয়া এই ঘটনার পেছনের গভীরতা বোঝ, দেখবে, কিভাবে ধর্মের নামে এক নতুন জোট ইসলামী খেলাফতের পিঠে ছুরি চালিয়েছিল।

বন্ধুগণ!
১৭০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে আরব উপদ্বীপের মধ্যাঞ্চল নজদ ছিল একেবারেই ভিন্ন এক দৃশ্যপট। সেখানকার লোকেরা বেদুইন জীবনযাপনে অভ্যস্ত। গোত্রে গোত্রে বিবাদ, কূপের পানি নিয়ে হানাহানি, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা – সবমিলিয়ে স্থিরতা ছিলই না।

তখনও মক্কা-মদিনা ছিল ওসমানি খেলাফতের সরাসরি শাসনে। সারা মুসলিম বিশ্বকে এক ছাতার তলে ধরে রেখেছিল ওসমানি খিলাফত। ইসলামি ঐক্য, উম্মাহর একতা ও বাইরের শত্রুরা যেন হানা না দিতে পারে, তার জন্য ছিল এই খেলাফতের কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী, শাসনব্যবস্থা ও এক শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ।

বন্ধুগণ!
ঠিক সেই সময় নজদের উয়াইনা নামক একটি গ্রামে জন্ম নিলো মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওহাব (১৭০৩ খ্রি.)।
তিনি হানবলী মাজহাবের কিছু মাদরাসায় পড়াশোনা করেন, পরে মক্কা ও মদিনায় গিয়ে সেখানে ইসলামি বিদ্যা শিখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তার মনোভাব ক্রমেই হয়ে উঠছিল কট্টর বা গোড়া।

তিনি খুব বেশি জোর দিচ্ছিলেন এমন ‘তাওহীদ’-এর ওপর, যেখানে তিনি প্রচলিত বহু প্রথা যেমন:
• কবর জিয়ারত,
• নবীর দরুদ, তাওয়াসসুল,
• মিলাদ, বার্ষিক ওরস — সবকিছুকেই শিরক আখ্যা দিচ্ছিলেন।

এভাবে তিনি একটি অত্যন্ত কঠোর শিরক-বিরোধী (তার ভাষায়) আন্দোলন গড়ে তুলতে শুরু করলেন, যা সে সময়ের বহু ওলামার দৃষ্টিতে ছিল সীমালঙ্ঘন।

বন্ধুগণ!
তাকে নিয়ে স্থানীয় মুফতিগণ ফতোয়া দিলেন যে, তার এই কথাবার্তা ইসলামের হাজার বছরের ইজমা ও উম্মাহর ঐক্যকে ভেঙে দিচ্ছে। ফলে তাকে তার জন্মস্থান উয়াইনা থেকে বিতাড়িত করা হয়।

এরপর তিনি নাজদের দিরইয়াহ অঞ্চলে পাড়ি জমান। এখানে তার সঙ্গে দেখা হলো এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার অধিকারী শাসক মুহাম্মদ ইবন সউদের সাথে।

বন্ধুগণ!
এই মুহূর্তটি ইসলামী ইতিহাসের জন্য এক মোড় ঘোরানো ঘটনা। দুই জন মানুষ —
• একজন ধর্মীয় নেতা, যে ইসলামের নামে তার কঠোর ব্যাখ্যা চালু করতে চায়,
• আরেকজন একজন রাজা, যে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধরত বেদুইনদের দমিয়ে তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চায়।

তারা দুজন একে অপরের হাত ধরলো।
মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওহাব বললেন:
“আমি তোমার রাজত্বকে আসমানি বৈধতা দেবো, শর্ত একটাই — আমার তাওহীদের আন্দোলন অবাধে চালাতে দিতে হবে।”

মুহাম্মদ ইবন সউদ খুশি হলেন। বললেন:
“তোমার দাওয়াতি যুদ্ধের তলোয়ার আমি হবো। এই আন্দোলন বিস্তারে আমি সামরিক শক্তি দেবো।”
এভাবে ধর্ম ও রাজনীতির মিশেল তৈরি হলো, যার ফলে এক নতুন ‘ওহাবি-সউদি প্রজেক্ট’ গড়ে উঠলো।

বন্ধুগণ!
তাদের শাসন বিস্তারের কৌশল ছিল সহজ — ১. প্রথমে আশেপাশের গোত্রগুলোতে ‘তাওহীদ’ নামের দাওয়াতি দল পাঠানো হতো। ২. তারা যদি রাজি না হয়, তাহলে সামরিক অভিযান চালানো হতো। ৩. অঞ্চলটি দখল করার পর সেখানকার মাজার, কবর, স্থাপত্য ভেঙে ফেলা হতো। ৪. জনগণকে বলা হতো, “এখন থেকে ওহাবি তাওহীদ মানতে হবে, নইলে মুরতাদ।”

এভাবে দিরইয়াহকে রাজধানী করে তারা একের পর এক অঞ্চল দখল করলো। যে সকল মাজহাবি আলেম তাদের বিরোধিতা করতেন, তাদের হত্যা বা বিতাড়ন করা হতো।

বন্ধুগণ!
তখনকার নজদ ও হিজাজে চার মাজহাবের আলেমরা ছিল সক্রিয়। বহু শহর ছিল শাফেয়ী, হানাফী বা মালিকী মতাদর্শে সমৃদ্ধ। তাদের মাদরাসা, কিতাবখানা, দরস-হাদিসের জলসা জমজমাট ছিল।

কিন্তু মুহাম্মাদ ইবন সউদ ও মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওহাবের এই জোট আসার পর তাদের অবস্থা করুণ হয়ে যায়।
• বহু আলেমকে হত্যা করা হয় “মুশরিক” বা “বিদ‘আতি” তকমা দিয়ে।
• মসজিদের লাইব্রেরি ধ্বংস করে ওহাবি ফতোয়ার বই আনা হয়।
• সাধারণ মানুষকে কবর জিয়ারত, মিলাদ, মাওলিদ থেকে জোর করে ফিরিয়ে আনা হয়।
• শিশুরাও বড় হতে থাকে নতুন ‘ওহাবি তাওহীদ’ ভিত্তিক শিক্ষায়।

বন্ধুগণ!
তারা ইসলামের ১৩০০ বছরের ইতিহাস ও শৈল্পিক সৌন্দর্যকেও ধ্বংস করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি।
• বহু সাহাবি, তাবেয়ি ও আউলিয়াদের কবর সমতল করে দেয়া হলো।
• প্রাচীন মসজিদ ভেঙে নতুন সরল কাঠামো তৈরি করা হলো।
• যেন মুসলমানের হৃদয়ে কবর বা আউলিয়ার প্রতি সম্মান না থাকে, সেটিই তাদের মূল টার্গেট ছিল।

বাইজেন্টাইন বা ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র – ওসমানীয়দের দৃষ্টিকোণ
বন্ধুগণ!
তখন অটোমান খেলাফত বাইজেন্টাইনদের (Eastern Roman ধ্বংসের পরও ইউরোপিয়ান শক্তির বংশধর) ও ক্রুসেডারদের নতুন নতুন ষড়যন্ত্রে নাজেহাল ছিল। ইউরোপ তখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিপ্লবের ফলে অটোমানদের চেয়ে সমরাস্ত্রে এগিয়ে যাচ্ছিল।

এ অবস্থায় যখন নজদে এই নতুন বিদ্রোহী আন্দোলন তৈরি হলো, তখন ইউরোপিয়ান ও ব্রিটিশ কূটনীতিকরা এদের দিকে হাত বাড়ালো।
• পরবর্তীতে দেখা যাবে, ব্রিটিশরা সৌদি গোত্রগুলোর কাছে অস্ত্র, গোলাবারুদ, অর্থ ও পরামর্শ পৌঁছে দিচ্ছে।
• ফলে অটোমান খেলাফত একদিকে ইউরোপের সীমান্তে ক্রমাগত চাপ, অন্যদিকে আরবের বুকে নিজেরাই নিজের বিরুদ্ধে তলোয়ার তুলছে।

অটোমান ইতিহাসকারদের ভাষায় এটি ছিল “অভ্যন্তরীণ ফিতনা”, যা ইসলামের কেন্দ্র হিজাজে অটোমান শাসনের ওপর আঘাত হেনে পশ্চিমাদের হাতে শক্তি তুলে দিল।

মুসলিম উম্মাহ কী হারালো?
বন্ধুগণ!
ওসমানীয়দের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে স্পষ্ট হয়:
• মুসলিম উম্মাহ হারালো তার হাজার বছরের মাযহাবি সহাবস্থান।
• হারালো ঐতিহাসিক মাজার, কবর, দরগাহ, মসজিদ, কিতাবখানা।
• মুসলিম উম্মাহর হৃদয় থেকে ভালবাসা, ইতিহাসের সাথে আত্মিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো।
• হারালো একতাবদ্ধ খেলাফত, যার কারণে পরে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পুরো খেলাফত ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়।


মক্কা-মদিনার দিকে ওহাবি অগ্রযাত্রা
বন্ধুগণ!
আমরা দেখেছিলাম কিভাবে মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওহাব ও মুহাম্মদ ইবন সউদ একে অপরের হাত ধরে দিরইয়াহ থেকে একটি কঠোর তাওহীদবাদী শাসন বিস্তার শুরু করেছিল।

কিন্তু তাদের লোভ থেমে থাকলো না। লক্ষ্য ছিল ইসলামের দুই পবিত্র শহর — মক্কা ও মদিনা।
কারণ এগুলো দখল করলে কেবল আরব নয়, পুরো মুসলিম দুনিয়ার ওপর ধর্মীয় কর্তৃত্ব দাবি করা যাবে।

মুহাম্মদ ইবন সউদের মৃত্যুর পর তার ছেলে আবদুল আজিজ ইবন মুহাম্মদ (দ্বিতীয় ইমাম) আরো আগ্রাসী হয়ে উঠলো। তাদের বাহিনী ধীরে ধীরে হিজাজের দিকে অগ্রসর হলো।

মক্কা ও মদিনা দখলের ঘটনা
বন্ধুগণ!
১৮০৩ সালে তারা মক্কা আক্রমণ করে এবং প্রায় কোন বড় যুদ্ধ ছাড়াই দখল করে ফেলে। মক্কার শেরিফ (শরীফ ঘরানার শাসক), যিনি অটোমানদের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন, তখন সৈন্য-সম্বলহীন অবস্থায় পিছু হটে যান।

পরের বছর ১৮০৪ সালে তারা মদিনাও দখল করে নেয়। এরপর শুরু হয় সেই ঐতিহাসিক ধ্বংসযজ্ঞ।
• মদিনায় জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে সাহাবা, তাবেয়ি ও আহলে বাইতের বহু কবর চিহ্নিত ছিল।
• তারা সব চিহ্ন মুছে সমতল করে ফেলে।
• বহু প্রাচীন গম্বুজ, কবরের উপরের দালান ভেঙে ফেলে।
• একই কাজ মক্কাতেও করে।

তাদের যুক্তি ছিল:
"এই কবরগুলো মানুষকে শিরক করায়। মানুষ কবরের সামনে হাত তুলে মুনাজাত করে, যা আল্লাহর সাথে শিরক।"

অথচ শত শত বছর ধরে কবর জিয়ারত, দরুদ ও নবীর উসিলা চাওয়া ইসলামের মূল ধারার মধ্যে চালু ছিল। এমনকি প্রখ্যাত হানাফী, শাফেয়ী, মালিকী, হানবলী ইমামদেরই ফতোয়া ছিল কবর জিয়ারত সুন্নত।

ওসমানীয় খিলাফতের প্রতিক্রিয়া
বন্ধুগণ!
খিলাফতের রাজধানী ইস্তাম্বুলে খবর পৌঁছতে দেরি হয়নি।
অটোমান সুলতান তখন বুঝলেন, এ শুধু মক্কা-মদিনা দখল নয়, বরং পুরো উম্মাহর নেতৃত্বের ওপর আঘাত। কারণ ওসমানীয় সুলতান ছিলেন ‘খাদিমুল হারামাইন শরীফাইন’ (দুই পবিত্র হারাম মসজিদের খাদেম)।

সরাসরি অটোমান বাহিনী তখন ইউরোপের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে থাকায় হিজাজে সেনা পাঠানো কঠিন হয়ে যায়।
তখন সুলতান মিশরের গভর্নর মুহাম্মদ আলী পাশার দিকে চেয়ে থাকলেন।

মিশরীয় বাহিনী ও প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের পতন
বন্ধুগণ!
মিশর তখন অটোমানদের অধীন ছিল। মিশরের শাসক মুহাম্মদ আলী পাশা তার পুত্র তুসুন পাশা ও পরে ইব্রাহিম পাশাকে একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে সৌদি নজদ অঞ্চলের দিকে প্রেরণ করলেন।
• তারা ১৮১১ সালে হিজাজের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলো।
• ধাপে ধাপে মক্কা ও মদিনা পুনর্দখল করলো।
• তারপর সরাসরি নজদের দিকে এগিয়ে গেলো।

দিরইয়াহ ঘিরে ধরে ১৮১৮ সালে প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের অবসান ঘটায়।
মুহাম্মদ ইবন সউদের বংশধরেরা নিহত ও বন্দী হয়। মুহাম্মদ ইবন আব্দুল ওহাব ইতোমধ্যে মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু তার ছেলেদের ও অনুসারীদের ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো।

মুসলিম উম্মাহর হারানো ইতিহাস – ওসমানীয়দের দৃষ্টিকোণ

বন্ধুগণ!
ওসমানি খিলাফতের ইতিহাসবিদরা একে স্পষ্টতই লিখেছেন “আরবের বিদ্রোহী ফিতনা” বলে। তাদের ভাষায় এটি ছিল ইসলামী উম্মাহর ঐক্যের বিরুদ্ধে এক অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র।
• কারণ এর মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজ বিভক্ত হলো,
• মুসলিম মাযহাবি সহনশীলতা নষ্ট হলো,
• ইসলামের ইতিহাস, শৈল্পিক ঐতিহ্য ও কবরগুলো ধ্বংস হলো,
• আর মক্কা-মদিনার দখল একটি কালো অধ্যায় হয়ে থেকে গেল।

অটোমানরা মক্কা-মদিনায় পুনরায় তাদের প্রশাসন চালু করলেও, অনেক প্রাচীন নিদর্শন ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই ক্ষতি আর কখনো পূরণ হলো না।

সাময়িক শান্তি কিন্তু নতুন চক্রান্তের বীজ
বন্ধুগণ!
মিশরীয় বাহিনী দিরইয়াহ ধ্বংস করায় অটোমানরা কিছুটা স্বস্তি পেলেও, ইউরোপ তখন নতুন নতুন কৌশল বুনছিল।
• তখন ব্রিটিশরা সরাসরি তুর্কি খেলাফতের পতনের চক্রান্ত করছিল।
• আরব উপদ্বীপে সউদ বংশকে আবার সংগঠিত করতে শুরু করলো।
• ওহাবিদের নতুন নতুন আশ্রয়, অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করা হলো।
অল্প সময়ের মধ্যেই, আব্দুল্লাহ ইবন সউদের বংশধররা ধীরে ধীরে আবার ক্ষমতা কায়েম করতে শুরু করলো।

তেলের খনি, ব্রিটিশ প্রোটেক্টরেট ও দ্বিতীয় সৌদি রাষ্ট্র
বন্ধুগণ!
উনবিংশ শতকের শেষের দিকে আরবের মাটিতে তেলের সম্ভাবনা দেখা দিল।
ব্রিটিশরা আরবদের ব্যবহার করতে চাইল অটোমানদের বিরুদ্ধে।

তারা সউদ পরিবারের সাথে গোপন সন্ধি করে —
“আমরা তোমাদের সাহায্য করবো, শর্ত একটাই — তোমরা খিলাফতের বিরোধিতা করবে এবং তেল-চুক্তি করবে আমাদের সাথে।”

এই ষড়যন্ত্রের ফলে আবার ১৯০২ সালে আব্দুল আজিজ ইবন সৌদ ব্রিটিশ সহযোগীতায় রিয়াদ পুনর্দখল করলো।
তারপর ধীরে ধীরে গোটা নজদ, তারপর হিজাজ, এবং ১৯৩২ সালে পুরো সৌদি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলো।

ওহাবি বিশ্ববিদ্যালয় ও দাওয়াহ ইম্পোর্ট-এক্সপোর্ট
বন্ধুগণ!
তেলের টাকা আসতে থাকলো। আরবের বুকে তখন শুরু হলো এক নতুন রকমের দাওয়াহ প্রজেক্ট।
• স্থাপিত হলো মদিনার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি (১৯৬১), যেখানে ওহাবি (সালাফি) মানসিকতার আলেমদের তৈরি করে বিশ্বজুড়ে পাঠানো হতে লাগলো।
• ব্রিটিশ ও পরে আমেরিকার সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলায় সৌদি শাসকরা পশ্চিমাদের সামরিক সুরক্ষা পেল, এবং বিনিময়ে তেলের নিয়ন্ত্রণের বড় অংশ পশ্চিমাদের হাতে চলে গেল।

এভাবে সৌদি থেকে শুরু হলো ওহাবি বা সালাফি তাওহীদের এক বিশ্বব্যাপী রপ্তানি।
• আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে মসজিদ ও মাদরাসা ফান্ড করা হতে থাকলো।
• এর মাধ্যমে স্থানীয় হানাফী, শাফেয়ী, মালিকী মাজহাবের সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হলো।

ওসমানীয়দের চোখে কি হারাল মুসলিম বিশ্ব?
বন্ধুগণ!
ওসমানীয় ইতিহাসবীদ ও আলেমরা বলতেন:
“আমরা হারিয়েছি আমাদের ইসলামী শুরা শাসনব্যবস্থা, হারিয়েছি মাযহাবি সহাবস্থান, হারিয়েছি পবিত্র শহরগুলোর ইতিহাস ও সৌন্দর্য।
এর চেয়েও বড় ক্ষতি হলো উম্মাহর হৃদয় থেকে খেলাফতের প্রতি আনুগত্য উঠে গিয়ে জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী, ওহাবি রঙ ঢুকে গেল।”

তেল-অর্থনীতি, দাওয়াহ রপ্তানি ও উম্মাহর বিভাজন – ওসমানীয়দের চোখে ওহাবি সাম্রাজ্য

তেল আবিষ্কার : ইতিহাসের ভয়াবহ মোড়

বন্ধুগণ!
আমরা দেখেছি কিভাবে প্রথম সৌদি রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে গেলেও, ব্রিটিশ কূটনীতির ছলনায় আবার সৌদ বংশ পুনরুত্থান ঘটায়।
কিন্তু আরেকটি ঘটনা ইতিহাসের চাকা সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিল — আরবের বুকে তেলের খনি আবিষ্কার।

১৯৩৮ সালে সৌদি আরবের ধাহরান অঞ্চলে প্রথম বাণিজ্যিক তেল-খনি আবিষ্কার হয়। তারও আগে ১৯৩৩ সালে সৌদরা আমেরিকান কোম্পানি স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়া (যা পরে আরামকো হয়) এর সাথে প্রথম তেল চুক্তি করে।

বন্ধুগণ!
এখানেই শুরু হলো নতুন এক যুগ —
• সৌদি রাজপরিবার হাতে পেলো তেলের অপরিসীম সম্পদ,
• আর তেলের নিরাপত্তার বিনিময়ে সরাসরি নিজেদেরকে পশ্চিমাদের রক্ষাকবচে পরিণত করলো।

এভাবে ব্রিটিশদের ছায়া থেকে সরাসরি আমেরিকার সামরিক ছায়ায় চলে গেলো সৌদি রাজতন্ত্র।

“ওহাবী তাওহীদ” এর বিশ্বব্যাপী রপ্তানি
বন্ধুগণ!
তেলের বিশাল আয় থেকে সৌদ পরিবার সিদ্ধান্ত নিল, তাদের মতবাদ — অর্থাৎ ওহাবি সালাফি আকিদা — সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে হবে।
কারণ তারা বুঝেছিল, কেবল অর্থনৈতিক শক্তি নয়, ধর্মীয় কর্তৃত্বই তাদের টিকে থাকার বড় হাতিয়ার।
এরপর শুরু হলো বিশাল বাজেটের এক আন্তর্জাতিক দাওয়াহ প্রজেক্ট:

১️⃣ মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি
১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠা হলো মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি।
• এখানে ওহাবি মানসিকতার আলেমদের তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো শুরু হলো।
• আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া — সব জায়গায় এদের মিশন গড়ে উঠলো।

২️⃣ বিশ্বজুড়ে মসজিদ ও মাদরাসা ফান্ড
সৌদি আরব থেকে কোটি কোটি ডলার দিয়ে মসজিদ, মাদরাসা, লাইব্রেরি তৈরি হতে লাগলো।
• যেখানে আগে স্থানীয় মাযহাবি ইসলামের চর্চা হতো, সেখানে ওহাবি পুস্তক, বক্তা, ফতোয়া ঢুকে পড়লো।
• ধীরে ধীরে এই স্থানীয় ইসলামি সংস্কৃতি ভেঙে এক নতুন কঠোর তাওহীদ ব্যাখ্যা চাপিয়ে দেয়া হলো।

৩️⃣ দাওয়াহ সংস্থা ও মিডিয়া সাম্রাজ্য
“রাবেতা আল আলম আল ইসলামি”, “মুয়াসসাসা হারামাইন”, “আইআরএফ” ইত্যাদি নামে প্রায় শত শত দাওয়াহ এনজিও বিশ্বজুড়ে গড়ে তোলা হলো।
• স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, ইসলামী বই বিতরণ, অনুবাদ — সবকিছুই চালানো হলো এই তেলের অর্থে।

ওসমানীয় দৃষ্টিকোণ : উম্মাহর বিভাজন
বন্ধুগণ!
ওসমানীয় ঐতিহাসিকদের চোখে এই ঘটনা ছিল এক গভীর দুঃখের।
তাদের দৃষ্টিতে মুসলিম উম্মাহর যে ঐক্য ছিল, তা সম্পূর্ণ চূর্ণ হয়ে গেল এই প্রজেক্টের মাধ্যমে।
• আগে হিজাজের মুসলিমরা নিজেদেরকে খেলাফতের অংশ মনে করতো।
• মক্কা-মদিনা ছিল সকল মাজহাবের জন্য উন্মুক্ত, যেখানে হানাফি, শাফেয়ী, মালিকী, হানবলী আলেমরা একসাথে ইজতিমা করতো।
• কবর জিয়ারত, দরুদ, ওরস, বার্ষিক মীলাদ — সবকিছু ছিল ইসলামি সমাজের স্বাভাবিক সংস্কৃতি।

কিন্তু এখন সৌদি শাসন সেসবকে “শিরক, বিদ‘আত, কুফর” বলে দমিয়ে দিতে শুরু করলো।
• যারা মাজারে যেত, তাদেরকে বলা হলো মুশরিক।
• যারা নবীর দরুদ, উসিলা, তাওয়াসসুলে বিশ্বাস করতো, তাদের ফতোয়া দেয়া হলো “তাওহীদ নষ্টকারী।”

মুসলিম দেশে মাজহাবি সহাবস্থান বিনষ্ট
বন্ধুগণ!
এভাবে মুসলিম সমাজে:
• হানাফী, শাফেয়ী, মালিকী, জাফরী — সবাই সন্দেহের চোখে একে অপরের দিকে তাকাতে শুরু করলো।
• এক দেশ আরেক দেশের মুসলিমকে ‘ঠিক মুসলিম নয়’ ভাবতে শুরু করলো।
• মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, হৃদয়ের বন্ধন ও ইজমা-ভিত্তিক শালীনতা নষ্ট হয়ে গেল।

মুফতি ও ওলামাদের স্তরভেদ তৈরি
বন্ধুগণ!
আরো ভয়ংকর হলো, যখন এই নতুন তাওহীদ ব্যাখ্যার লোকেরা দেশদেশান্তরে গিয়ে স্থায়ী হলো।
• পাকিস্তান, বাংলাদেশে “আহলে হাদিস” নামে তাদের শাখা মজবুত হলো।
• শাফেয়ী অধ্যুষিত ইন্দোনেশিয়ায়, মালয়েশিয়ায় নতুন নতুন “সালাফি গ্রুপ” তৈরি হলো।

তারা বহু জায়গায় স্থানীয় মাজহাবি ওলামাদের “তাক্বলীদী অন্ধ” বলে আক্রমণ করতে থাকলো।
• এতে সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো।
• এক ইমামের পেছনে নামাজ পড়া নিয়েও ফিতনা শুরু হলো।

কাবা ও মসজিদে নববীর প্রাচীন ইতিহাস বিলুপ্ত
বন্ধুগণ!
ওসমানীয়দের চোখে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল মক্কা-মদিনার চেহারা বদলে যাওয়া।
• হাজার হাজার সাহাবা, তাবেয়ি, ইমামদের কবরসমূহ ছিল, যা ওসমানীয়রা সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করেছিল।
• জনতা সেগুলো দেখে ইসলামের ইতিহাসের সাথে আত্মিক বন্ধন অনুভব করতো।

কিন্তু ওহাবি শাসকরা প্রায় সব কবর গম্বুজ ও স্থাপত্য ধ্বংস করে সমতল করে দিল।
• জান্নাতুল বাকি ও জান্নাতুল মুআল্লায় আজ আর কোনো গম্বুজ নেই।
• মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসের সেই জীবন্ত স্মৃতিগুলো মুছে গেল।

ইসলামের শূরা শাসন বনাম সৌদি রাজতন্ত্র
বন্ধুগণ!
ওসমানীয়দের খেলাফত ছিল একটি শূরা ভিত্তিক সমন্বিত শাসন।
• কেন্দ্রে একজন খেলাফা থাকলেও স্থানীয় আলেম, উমারা, জনতা — সবাই একটি রাজনৈতিক শুরা পদ্ধতিতে সম্পৃক্ত হতো।

কিন্তু সৌদি রাজতন্ত্র একেবারে বিপরীত:
• এখানে একটি পরিবার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে।
• জনগণ কোনো শুরা বা খিলাফায় অংশীদার নয়।
• শাসন চলে রাজপ্রাসাদ থেকে, আলেমদেরকেও রাজপরিবার বেতন দেয় — যারা মূলত রাজপরিবারের ফতোয়া অনুযায়ী কথা বলেন।

পশ্চিমাদের সাথে জোট — বাইজেন্টাইন ছায়ার পুনর্জন্ম?
বন্ধুগণ!
ওসমানীয়দের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ ছিল এটাই:
“যে পরিবার এক সময় আমাদের বিরুদ্ধে মক্কা-মদিনা দখল করেছিল, আজ তারা তেল আর অর্থের জন্য ইহুদী খ্রিষ্টানদের সরাসরি বন্ধু হয়ে গেছে।”
• ১৯৪৫ সালে আব্দুল আজিজ ইবন সৌদ সরাসরি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সাথে চুক্তি করলেন।
• এরপর সৌদি আরবে মার্কিন সেনা ঘাঁটি তৈরি হলো।
• পরে গালফ ওয়ার, ইরাক যুদ্ধ — সবকিছুতে সৌদি ভূমি ব্যবহার করলো, পশ্চিমারা মুসলিম রাষ্ট্র আক্রমণের জন্য।

এভাবে ওসমানীয়দের দৃষ্টিতে সৌদি রাজতন্ত্র হলো সেই বাইজেন্টাইন শক্তির ছায়াতলে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র তুলে দেওয়া — যেটা তারা শত শত বছর ধরে ঠেকিয়ে রেখেছিল।

উম্মাহর আজকের বিভক্তি
বন্ধুগণ!
আজ মুসলিম উম্মাহর দিকে তাকাও —
• এক দেশে আহলে হাদিস, অন্য দেশে হানাফি, আরেক দেশে শাফেয়ী-সালাফি বিরোধিতা,
• এক দেশে ওরস-গাউসিয়া হলে অন্য দেশে ফতোয়া জারি হয় “এরা মুশরিক”।

এটা কি সেই উম্মাহ, যার জন্য আল্লাহ বলেছিলেন:
“واعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرقوا”
“তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।”
(সূরা আলে ইমরান ৩:১০৩)

সত্যিকারের তাওহীদ, ইসলামী শূরা ও উম্মাহর ভবিষ্যৎ
বন্ধুগণ!
আজ আমরা বারবার শুনি “তাওহীদ”, “শিরক”, “বিদ‘আত”, “মুশরিক” — এই শব্দগুলো এমনভাবে প্রচারিত হচ্ছে, যেন কুরআনের মূল মর্মটিই হারিয়ে যাচ্ছে।
কুরআনের তাওহীদ হলো —
• • আল্লাহর একত্ব, একক উপাস্যতা, একক বিধান (হুকুম)।

• যার কোনো অংশ রাজা, গোষ্ঠী বা আলেমের ইচ্ছায় ভাগ হবে না।

আল্লাহ বলেন:
“إن الحكم إلا لله أمر ألا تعبدوا إلا إياه”
“হুকুম (আইন প্রণয়ন ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত) কেবল আল্লাহর। তিনি আদেশ করেছেন, যেন তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করো।”
(সূরা ইউসুফ ১২:৪০)

তাওহীদ মানে এই নয় যে—
• কেবল কবরের কাছে দোয়া না চাওয়া,
• অথবা মাজারে না যাওয়া,
• কিংবা মসজিদে সরল গম্বুজ না বানানো।
বরং প্রকৃত তাওহীদ হলো সমস্ত বিধান, বিচার, শাসন ও আনুগত্য এককভাবে আল্লাহর হাতে রাখা।
আর ইসলামী শূরা শাসনব্যবস্থা সেই তাওহীদ ভিত্তিক ন্যায় ও পরামর্শপ্রধান নেতৃত্ব, যেখানে কোনো রাজতন্ত্র নেই।

ইসলামি শূরা বনাম রাজতন্ত্র
বন্ধুগণ!
ইসলাম প্রথম দিন থেকে শূরার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল।
• রাসুল সা. যুদ্ধের আগে সাহাবাদের সাথে শূরা করতেন।
• হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমর (রাঃ) — কেউই বংশীয়ভাবে ক্ষমতা নেননি, বরং উম্মাহর পরামর্শ ও সম্মতিতেই নেতৃত্বে আসেন।

কুরআন স্পষ্ট বলছে:
“وأمرهم شورى بينهم”
“তাদের সকল কাজ পরস্পর পরামর্শের মাধ্যমে চলে।”
(সূরা আশ-শূরা ৪২:৩৮)

কিন্তু সৌদি-ওহাবি প্রজেক্টে আমরা কী দেখছি?
• একটি পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম রাজা হয়ে যাচ্ছে।
• জনগণ, উলামা, মুজাহিদিন — কেউ শাসন ক্ষমতায় অংশীদার নয়।
• ওলামারা মূলত রাজপরিবারের নিয়োগপ্রাপ্ত দাসে পরিনত হলো। তারা সেই ফতোয়াই দেন, যা রাজতন্ত্র টিকে থাকার জন্য দরকার।
এটাই প্রকৃত তাওহীদের সাথে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা।

ওসমানীয় মডেল কেন অনন্য ছিল?
বন্ধুগণ!
ওসমানীয় খেলাফত শত শত বছর ইসলামী শূরার এক মডেল ছিল, যদিও তারও কিছু ত্রুটি মানবীয় কারণে থেকে গিয়েছিল।

কিন্তু তাদের মূলনীতি ছিল:
• খেলাফা আল্লাহর আইন অনুযায়ী শাসন করবেন।
• আলেম, মুফতি, উমারা ও সেনাপতিরা শূরার মাধ্যমে খেলাফার সাথে যুক্ত থাকবেন।
• পুরো উম্মাহকে এক কাতারে রাখা হবে, যাতে বাইরের শত্রু হানা দিতে না পারে।

তারা মক্কা-মদিনার দায়িত্ব নিলেন “খাদিমুল হারামাইন” হিসেবে — অর্থাৎ খোদার মসজিদের খাদেম।
• তারা কখনো নিজেদেরকে “মালিকুল হারামাইন” (মক্কা-মদিনার রাজা) বলেনি।
• তারা দুই হারামের সকল মাজহাবের আলেমদের সমান সম্মান দিতেন।

সৌদি রাজতন্ত্র তার বিপরীতে দুই হারামকে সরাসরি তাদের পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেললো।

কিভাবে সৌদি মডেল প্রকৃত খেলাফত ও তাওহীদকে লঙ্ঘন করলো?

বন্ধুগণ!
সৌদি-ওহাবি প্রজেক্টে চারটি বড় ক্ষতি হলো:

১️⃣ শাসন আল্লাহর নয়, পরিবার-রাজতন্ত্রের হাতে চলে গেল
• ইসলামী শূরার বদলে একটি গোত্রীয় বংশ শাসক হয়ে বসল।
• তারাই আইন করবে, তারাই ফতোয়া ঠিক করবে।

২️⃣ ইসলামী ঐতিহ্য ও ইতিহাস মুছে ফেলা হলো
• মাজার, কবর, গম্বুজ, তাবেয়ি-তাবে তাবেয়ি যুগের স্মৃতি ধ্বংস।
• যাতে মুসলিম ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও সংযোগ মুছে যায়।

৩️⃣ ইসলামের বৈচিত্র্যময় মাজহাবি সহাবস্থান ভেঙে একরঙা করা হলো
• শাফেয়ী, হানাফি, মালিকি, হানবলি আলাদা আলাদা দরস হতো, এখন একরঙা ওহাবি মডেল চাপিয়ে দেওয়া হলো।
• কবর, দরুদ, উসিলা, তাওয়াসসুলের নামে শত শত বছরের আমলকে শিরক বলে লোক হাস্যকর ফতোয়া দিল।

৪️⃣ ইসলামকে পশ্চিমাদের সহযোগী বানিয়ে ফেলা হলো
• ব্রিটিশ ও পরে আমেরিকান সামরিক চুক্তি করে তাদের ছায়াতলে থেকে পুরো তেলনীতি চালাল।
• এরপর আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া — সর্বত্র মুসলিম রক্তে পশ্চিমা যুদ্ধের অংশীদার হলো।

ওসমানীয়দের শেষ ওসিয়ত
বন্ধুগণ!
ওসমানীয়দের শেষ খলিফা সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয় (যাকে পশ্চিমারা “রেড সুলতান” বলে কটাক্ষ করতো) তার রাজ্য পতনের আগে একটি কথাই বারবার বলতেন:

“মুসলিম উম্মাহর ঐক্যই খেলাফতের প্রাণ। যখনই তোমরা খেলাফতের শৃঙ্খল ভেঙে জাতি-গোত্রের নামে বিভক্ত হবে, শত্রুরা তোমাদের ঘর ভেঙে দেবে, রক্তপাত হবে।”
আজকের ওহাবি সৌদি মডেল তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

উম্মাহর করণীয় কী?
বন্ধুগণ!
আজ আমাদের করণীয় চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আছে:

১. প্রকৃত কুরআনি তাওহীদ বোঝা
• তাওহীদ মানে শুধু কবর ভাঙা নয়, বরং শাসন, আইন, বিধান আল্লাহর হাতে রাখা।
• শিরক মানে কেবল কবরের কাছে হাত তোলা নয়, বরং রাজা-রাজতন্ত্রকে আল্লাহর হুকুমের উপর বসিয়ে রাখা শিরক-ই-হাকিমিয়াত।

২. শূরা ভিত্তিক রাজনৈতিক ঐক্য গড়া
• মুসলিম দেশে শাসকরা যেন এককভাবে সিদ্ধান্ত না নেয়, বরং আলেম, উমারা, সমাজ সব শূরা সিস্টেমে থাকে।
• এই মডেল ছাড়া খেলাফতের কাঠামো ফিরে আসবে না।

৩. মাজহাবি সহাবস্থান ফিরিয়ে আনা
• শাফেয়ী হোক, হানাফি হোক, জাফরী হোক — সবাই যেন এক কাতারে থেকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা রাখে।

• কবর জিয়ারত, দরুদ, মিলাদ — এগুলোকে “শিরক” আখ্যা না দিয়ে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নরম হৃদয়ে দেখা।

৪. পশ্চিমাদের ছায়া থেকে বের হওয়া
• সৌদি মডেলের সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হলো তাদের তেল-অর্থনীতি ও সামরিক নির্ভরতা পশ্চিমা ইহুদি খ্রিষ্টানদের হাতে।
• মুসলিম উম্মাহকে তার অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও তাওহীদ — সবকিছু আল্লাহর ওপর এবং নিজের শূরার ওপর নির্ভরশীল করতে হবে।

বন্ধুগণ,
আজ আমরা এই বক্তব্যে জানতে পারলাম—
• কিভাবে মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওহাব ও মুহাম্মদ ইবন সউদের আঁতাত ইসলামী খেলাফতের পিঠে ছুরি চালিয়েছিল,
• কিভাবে মক্কা-মদিনা দখল হলো, প্রথম সৌদি রাষ্ট্র ধ্বংস হলো, আবার তেলের টাকায় ও পশ্চিমাদের ছায়ায় ফিরে এলো,
• কিভাবে তেলের পেট্রো-ইসলাম ও দাওয়াহ প্রজেক্ট উম্মাহর মাজহাবি ঐক্য নষ্ট করলো,
• আর কিভাবে আমরা আজ বিভক্ত, দুর্বল, নিজেদের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি।

শেষ আহ্বান
বন্ধুগণ! এই ইতিহাস আমাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক বড় শিক্ষা।
যদি আমরা কুরআনের শূরা, সহানুভূতি, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং প্রকৃত তাওহীদে ফিরে না আসি,
তাহলে আমাদেরও একের পর এক রাজা-আমিরদের ষড়যন্ত্রে, পশ্চিমাদের তেল-অস্ত্র-অর্থের ফাঁদে হারিয়ে যেতে হবে।

তাই আসুন,
• কুরআনের শূরায় ফিরি,
• প্রকৃত তাওহীদ বুঝি,
• মাজহাবি সহাবস্থান ফিরিয়ে আনি,
• খেলাফতের ঐক্য ও মুমিন হৃদয়ের বন্ধন গড়ে তুলি।


তথ্যসূত্র (References / Bibliography)

ইতিহাসের প্রাথমিক বইসমূহ
• ইবন বশর, “উনওয়ান আল-মাজদ ফি তারিখ নাজদ”
• (মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওহাব ও প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রধান আরব উৎস।)

• ইবন ঘান্নাম, “তারিখ নাজদ”
• (ওহাবি আন্দোলন ও মক্কা-মদিনা আক্রমণের সময়কার স্থানীয় বিবরণ।)

• Stanley Lane-Poole, “The Story of Turkey”
• (ওসমানীয় খেলাফতের শেষ সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা।)

• William Ochsenwald, “Religion, Society, and the State in Arabia: The Hijaz under Ottoman Control, 1840-1908”
• (হিজাজে ওসমানীয় প্রশাসন কেমন ছিল, তার বিস্তারিত আলোচনা।)

ওসমানীয় খেলাফত ও আরব অঞ্চলের সম্পর্ক
• Caroline Finkel, “Osman's Dream: The History of the Ottoman Empire”
• (ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিস্তার, প্রশাসনিক নীতি, ও শেষ পর্যায়ের রাজনীতি।)

• Albert Hourani, “A History of the Arab Peoples”
• (আরব বিশ্ব ও ওসমানীয় সম্পর্কের প্রেক্ষাপট।)

ওহাবি মতাদর্শ ও এর বিশ্বপ্রভাব

• David Commins, “The Wahhabi Mission and Saudi Arabia”
• (মুহাম্মদ ইবন আব্দুল ওহাবের দর্শন ও সৌদি শাসনের উত্থান।)

• Hamid Algar, “Wahhabism: A Critical Essay”
• (ওহাবিবাদের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ।)

• Madawi Al-Rasheed, “A History of Saudi Arabia”
• (সৌদি আরবের গঠন, ব্রিটিশ-আমেরিকান সম্পর্ক ও তেল রাজনীতি।)

হিজাজ ও কবরসমূহের ধ্বংস
• Sami Angawi, “The Destruction of Islamic Architectural Heritage in Saudi Arabia”
• (জান্নাতুল বাকী, জান্নাতুল মুআল্লা ও মসজিদের ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংসের তথ্যচিত্রমূলক রিসার্চ।)

• Ottoman archival documents (Başbakanlık Osmanlı Arşivi, Istanbul)
• (হিজাজের ওসমানীয় তত্ত্বাবধান, কবর, মাদরাসা, মসজিদ পুনঃনির্মাণের দলিল।)

তেল রাজনীতি ও পশ্চিমাদের সহযোগিতা
• Robert Vitalis, “America’s Kingdom: Mythmaking on the Saudi Oil Frontier”
• (তেল আবিষ্কার, আরামকো, এবং মার্কিন-সৌদি সম্পর্কের ভিতরকার গল্প।)

• Michael Doran, “The Saudi Paradox” (Foreign Affairs, 2004)
• (কিভাবে সৌদি আরব পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে।)

ইসলামী শূরা শাসন ও তাওহীদ প্রসঙ্গ
• Imam Al-Mawardi, “Al-Ahkam Al-Sultaniyyah”
• (ইসলামী শূরা, খেলাফত ও নেতৃত্বের ফিকহি কাঠামো।)

• Qur’an
• মূল আয়াতসমূহ:
• সূরা ইউসুফ ১২:৪০ (হুকুম কেবল আল্লাহর)
• সূরা আলে ইমরান ৩:১০৩ (ঐক্য)
• সূরা আশ-শূরা ৪২:৩৮ (শূরা)
• সূরা আল-হুজুরাত ৪৯:১০ (মুমিনদের ভাই ভাই)

📰 অন্যান্য প্রবন্ধ ও সমকালীন বিশ্লেষণ
• Academic articles from Journal of Arabian Studies & Islamic Quarterly
• (ওহাবিজমের সাম্প্রতিক বিশ্ব রূপান্তর।)

• Arab News & Al Jazeera archives
• (সৌদি তেলনীতি, মার্কিন সামরিক ঘাঁটি, গালফ ওয়ারের সময়কার রাজনৈতিক জোট।)

এগুলোই হলো প্রধান প্রামাণ্য ও গবেষণামূলক তথ্যসূত্র, যেখান থেকে আমি এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্য সাজিয়েছি। বিস্তারিত জানতে সুত্রগুলো পড়ুন।
এছাড়া বহু প্রাচীন উর্দু-ফারসি-তুর্কি ম্যানুস্ক্রিপ্ট থেকেও কোটেশন ও তথ্য নেয়া হয়েছে (বিশেষ করে দেওবন্দ, নিদামিয়া লাইব্রেরি ও ইস্তাম্বুল আর্কাইভ থেকে)।

Post a Comment

0 Comments