হাদিস ও মাজহাব মান্যকরা কি শিরক? যদি হয় তাহলে তা কিভাবে?
(মাহাতাব আকন্দ)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সারা মানবজাতির জন্য একমাত্র ধর্ম হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করেছেন এবং এই ইসলামের মূল ভিত্তি হলো তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ। তাওহীদ মানে—আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, এবং বিধান প্রবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁকে একক ও অদ্বিতীয় মনে করা। আর এই তাওহীদের বিপরীত হলো ‘শিরক’। শিরক মানে—আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার বানানো, তাঁর অধিকার অন্য কাউকে দেওয়া। অনেকেই মনে করে, শুধু মূর্তি পূজা করলেই শিরক হয়, কিন্তু না, এর বাইরেও বহু রকমের শিরক রয়েছে—যা সূক্ষ্ম, লুকোনো এবং চিন্তা ও বিশ্বাসের ভেতর বাসা বাঁধে।
বন্ধুগণ!
আমরা যারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করি, তাদের অনেকেই হয়তো অজান্তেই শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ি। কিভাবে? যখন আমরা আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে মানুষের বানানো আইন, মতবাদ, মতামত বা সমাজের রেওয়াজকে অধিকতর প্রাধান্য দিই—তখনই আমরা শিরকে জড়িয়ে পড়ি। অনেক মানুষ আল্লাহর কিতাব কুরআনের বদলে দলীয় বই, গোষ্ঠীগত ফতোয়া বা ব্যক্তির মতকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, “তারা কি আল্লাহ ব্যতীত অন্য শরীক গ্রহণ করেছে, যারা এমন শরিয়ত প্রবর্তন করে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?” (সূরা আশ-শুরা, আয়াত ২১)। এটি প্রমাণ করে—শরিয়তের বিধান প্রবর্তনের অধিকার একমাত্র আল্লাহরই।
বন্ধুগণ!
আজকের মুসলিম সমাজে এমন একটি ভয়ংকর ধোঁকা প্রচলিত হয়ে গেছে, যেখানে হাদীসকেও কুরআনের সমান্তরালে বা তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। অনেকেই মনে করে, রাসূল (সা.) নিজে শরিয়ত প্রবর্তন করেছেন। তারা হাদীসকে এমনভাবে মানে, যেন রাসূলের কথাই ‘আইন’ এবং আল্লাহর চেয়ে বড় দলীল! অথচ কুরআন স্পষ্ট বলছে—“আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য বিধান মানা শিরক।” রাসূল (সা.) আল্লাহর ওহী ব্যতীত কিছু বলেননি। তিনি ছিলেন ‘মুবাল্লিগ’ বা পয়গামপ্রদানকারী, শরিয়ত প্রবর্তনকারী নন। হ্যাঁ, তিনি ওহীর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বাস্তব জীবনে প্রয়োগ দেখিয়েছেন, কিন্তু নতুন করে শরিয়ত বানাননি। তাই হাদীসকে 'আলাদা শরিয়ত' মনে করা কিংবা হাদীস দিয়ে কুরআনের বিরোধিতা করা একটি সূক্ষ্ম শিরক।
বন্ধুগণ!
আমরা যদি কুরআনের আয়াতগুলো গভীরভাবে চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পাব—আল্লাহ তাআলা কেবল নিজেকেই ‘হাকিম’ বা বিধানদাতা বলেছেন। তিনি বলেন, “হুকুম কেবলমাত্র আল্লাহরই, তিনি আদেশ করেছেন, যেন তোমরা তাঁরই ইবাদত করো।” (সূরা ইউসুফ: ৪০)। কিন্তু যখন আমরা রাসূলের (সা.) কথা এমনভাবে গ্রহণ করি—যা আল্লাহর কুরআনের বিপরীতে যায় কিংবা কুরআনের বাইরে নতুন কিছু ‘ফরজ’ করে—তখনই আমরা কুরআনের নীতি থেকে বিচ্যুত হই এবং আল্লাহর একত্ববাদে ভাগ বসাই। আজকের যুগে কেউ কেউ এমন দাবিও করে বসে—“হাদীস ছাড়া ইসলামই চলে না!” অথচ বাস্তবতা হলো—কুরআনই পূর্ণাঙ্গ, সম্পূর্ণ এবং বিস্তারিত জীবনবিধান। হাদীসের স্থান কুরআনের ব্যাখ্যাকারী ও সহায়ক হিসেবে, কিন্তু শরিয়ত প্রবর্তক হিসেবে নয়।
বন্ধুগণ!
শিরকের আরেকটি রূপ হলো—নিজের খেয়াল-খুশিকে ‘ধর্ম’ বানিয়ে ফেলা। আল্লাহ বলেন, “তুমি কি তাকে দেখেছ, যে নিজের খেয়াল-খুশিকে উপাস্য বানিয়েছে?” (সূরা জাসিয়া: ২৩)। আজ আমরা অনেকেই বলি—“আমার মতে এটা ঠিক”, “আমার বিশ্বাস এটা বলে”, “আমার মন চায় না এটা মানতে”—এ ধরনের বক্তব্য আসলে নিজের মনকে আল্লাহর ওপর বসানোর নামান্তর। যখন কেউ বলে—“আমার আকল মেনে না, তাই কুরআনের এই আয়াত আমি মানি না”—সে তখন নিজের ‘বুদ্ধিকে’ ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে।
বন্ধুগণ!
আল্লাহর বিধান অস্বীকার করে মানুষের বানানো সংবিধান বা নিয়মকানুন মানা, আদালতে বিচার করতে গিয়ে কুরআনের বদলে ব্রিটিশ বা সেক্যুলার আইন মানা—এসবও সরাসরি শিরকের মধ্যে পড়ে। আল্লাহ বলেন—“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, তারা কাফির।” (সূরা মায়েদা: ৪৪)। অথচ আজকের সমাজে এই শিরক এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, মানুষ এটিকে ‘শিক্ষিত সমাজের নিয়ম’, ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধা’, বা ‘সভ্যতা’র অংশ মনে করে। কেউ কেউ আবার ইসলামের ভেতর থেকেই বলে—“শরিয়ত এখন বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য নয়!”—আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন এমন ভ্রান্ত চিন্তা থেকে।
বন্ধুগণ!
এই ভুলভ্রান্তি এবং শিরকের চোরাবালিতে পড়ে মুসলিম উম্মাহ আজ পথ হারিয়ে ফেলেছে। আমরা একদিকে নামায-রোযা করি, কিন্তু অন্যদিকে আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে মানুষের আইন, মতবাদ, দল বা ইমামের কথা মানি। কুরআন মানার বদলে হাদীস নিয়ে বিতর্ক করি। দল-মতের পেছনে ছুটে আল্লাহর একত্ববাদ ভুলে যাই। কেউ কেউ রাসূলের (সা.) কথাকে এমনভাবে তুলে ধরে—যেন তিনি আল্লাহর শরীক! অথচ রাসূল নিজেই বলেছেন—“তোমরা আমার কথা কুরআনের বিরোধীতায় ব্যবহার করো না।”
বন্ধুগণ!
আসুন আমরা ফিরে আসি তাওহীদের মূল ভিত্তিতে। আল্লাহকে একক বিধানদাতা, একক হুকুমদাতা, একমাত্র উপাস্য হিসেবে মানি। কুরআনকে একমাত্র জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করি। হাদীসকে আল্লাহর ওহীর ব্যাখ্যা হিসেবে সম্মান করি, কিন্তু শরিয়ত প্রবর্তক মনে না করি। নিজের খেয়াল-খুশিকে, সমাজের রেওয়াজকে বা দল-মতের ফতোয়াকে কুরআনের উপরে স্থান না দিই।
বন্ধুগণ!
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো—পূর্ববর্তী জাতিগুলো ধ্বংস হয়েছিল মূলত শিরকের কারণে। কিন্তু তারা সবাই কি মূর্তি পূজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল? না, বরং তারা নিজেদের আলেম, সন্ন্যাসী, গুরু, নেতাদের এমনভাবে মানতো, যেন তারা আল্লাহর সমকক্ষ। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“তারা নিজেদের আলেম ও সন্ন্যাসীদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছিল…” (সূরা তাওবা: ৩১)।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন—“তারা তাদের হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম করত, আর তারা তা মেনে নিত—এটাই তাদের ইবাদত ছিল।” (তিরমিযি)।
অর্থাৎ, যখন কোনো মানুষ অন্য মানুষের দেওয়া হালাল-হারাম মানে—যা আল্লাহ বলেননি—তখন সে সেই মানুষকে ইলাহ বানিয়ে ফেলেছে।
বন্ধুগণ!
আজকে যারা রাসূলের হাদীসকে আলাদা শরিয়ত মনে করে, কিংবা দলীয় ইমাম বা মুফতির কথা কুরআনের চেয়ে বড় করে দেখে, তারাও এই একই ভুলে পড়ে গেছে। তারা মুখে বলে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, কিন্তু অন্তরে অন্য কারো বিধানকেই ‘প্রধান’ মনে করে। এই অবস্থাকে আল্লাহ সূরা ইউসুফে ব্যাখ্যা করেছেন:
“তোমরা আল্লাহ ব্যতীত এমন কিছুরই উপাসনা করছো, যার কোনো প্রমাণ তিনি নাযিল করেননি; বিধান কেবলমাত্র আল্লাহরই।” (১২:৪০)
এখানে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে—যে কেউ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো বিধান বানায় বা মানে, সে শিরকে লিপ্ত হচ্ছে।
বন্ধুগণ!
এই শিরকের একটি আধুনিক রূপ হলো “আইডলাইজেশন” বা অন্ধভক্তি। কেউ কারো বক্তা, পীর, দলনেতা, আলেম, মুফতি বা রাজনৈতিক নেতার কথা এমনভাবে মানে, যেন সে অপরিহার্য। কেউ কেউ বলে—“যেহেতু উনি বলেছেন, তাই এটাই সঠিক।” অথচ সেই কথা যদি কুরআনের বিপরীত হয়, তবুও তারা সেই ব্যক্তির পক্ষে দাঁড়ায়। এটি শুধু একটি যুক্তির ভুল নয়—বরং একটি ঈমানের ভুল। আল্লাহ বলেন—“যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, এবং হিদায়াত পরিস্কার হওয়ার পরও মু’মিনদের পথ থেকে ভিন্ন পথে চলে, আমি তাকে ওখানেই রাখবো এবং জাহান্নামেই পৌঁছে দেবো।” (সূরা নিসা: ১১৫)
বন্ধুগণ!
শিরকের আরেক ভয়ংকর ফাঁদ হলো—আল্লাহর শরিয়তকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করা। অনেকে বলে, “এটা তো ১৪০০ বছরের পুরনো আইন”, “এটা এখনকার আধুনিক সমাজে চলে না।” এ কথা যে বলে, সে আসলে আল্লাহর আইনকে ‘বাতিলযোগ্য’ মনে করে, যা সরাসরি কুফরি ও শিরক। কারণ, আল্লাহর আইন চিরন্তন। রাসূল (সা.)-এর যুগে কিছু লোক কুরআনের আয়াত শুনে বলতো—“আমরাও বলতে পারি এমন কথা”, অথবা—“এটা তো কবিতার মতো।” আজকের যুগেও এই ধাঁচের কথা প্রচুর মানুষ বলে—“এই আইন অমানবিক”, “মহিলাদের প্রতি বৈষম্য”, “জিহাদ একটা সহিংসতা”, ইত্যাদি। এরা কেউ মুখে ইসলামের বিরুদ্ধে বলে না, কিন্তু মূলত আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে কথা বলেই তারা ঈমান হারিয়ে ফেলে।
বন্ধুগণ!
অনেকেই আজ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বা ‘সেক্যুলারিজম’ নামে একটি মতবাদে বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার, রাষ্ট্র বা সমাজে তার স্থান নেই। এটি আসলে আল্লাহর বিধানকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করে দেওয়া, যার ফলাফল হয়—মানুষ নিজেদের তৈরি আইনকেই ঈশ্বরের চেয়ে বড় মনে করে। অথচ কুরআনে বলা হয়েছে—“তোমরা কি কিতাবের একাংশ মানো এবং অন্য অংশ অস্বীকার করো?” (সূরা বাকারা: ৮৫)। যে ব্যক্তি কুরআনের পুরো শরিয়ত মেনে না চলে, বরং নিজের পছন্দমতো কিছু গ্রহণ করে, সে আল্লাহর পথে নয়—নিজের পথে চলছে।
বন্ধুগণ!
রাসূল (সা.) এর অবস্থান সম্পর্কে আমাদের বুঝতে হবে—তিনি শরিয়তের প্রবর্তক ছিলেন না, বরং আল্লাহর ওহী প্রচারকারী। তিনি বলতেন—“আমি কেবল ওহীর অনুসরণ করি।” (সূরা আনআম: ৫০)। অতএব, হাদীস সম্মানিত হলেও, সেটি কুরআনের অধীন। কুরআনের বিরোধিতাকারী হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়, এবং কুরআন ছাড়া কোনো হুকুম ফরজ হয় না। হাদীস যদি কুরআনের ব্যাখ্যা হয়—তবেই তা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যখন কেউ বলে—“এই হাদীসে বলা হয়েছে, তাই এটা ফরজ”, অথচ কুরআনে কোনো দলীল নেই—তখন সে একটি শিরকি চিন্তাধারায় আক্রান্ত।
বন্ধুগণ!
আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানা, হোক তা ভালো উদ্দেশ্যেও, একটি ভয়াবহ ভুল। সূরা তাওবার ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, তারা আলেমদের উপাস্য বানিয়েছিল। কিন্তু তারা তো নামায-রোযা ঠিকই করতো। তাহলে কীভাবে শিরক করলো?—তারা আলেমদের দেওয়া হালাল-হারামকে আল্লাহর হুকুমের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতো। আজ আমাদের সমাজেও একই অবস্থা। কেউ হুজুরের ফতোয়া মানে, কিন্তু কুরআনের আয়াত মানে না। কেউ ইমামের বয়ান কোট করে, কিন্তু আল্লাহর বিধান উপেক্ষা করে। এটা একেবারে ‘আধুনিক শিরক’।
0 Comments