কুরবানির ডাক! এ যেন এক ইখলাসের জিহাদ
বন্ধুগণ, তোমরা কি মনে করো, কুরবানি মানে শুধু পশু জবাই?
না, বন্ধুরা—এই তো বড় ভুল, বড় প্রবঞ্চনা।
যে ধর্মে প্রতিটি নিঃশ্বাসে ‘ইয়াকা নাবুদু’ উচ্চারিত হয়,
সেখানে শুধু ছুরি চালানোই কি ইবাদতের পূর্ণতা?
আল-কুরআন বলে:
“তোমরা বলো, আমার নামায, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু—সবই আল্লাহর জন্য।”
(সূরা আন-আম: ১৬২)
কুরআনের এই ঘোষণা কোনো সংবিধানের পাতার শ্লোগান নয়।
এ এক ইলাহী শপথ—জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি খোঁজার অঙ্গীকার।
কুরবানি মানে একবার গরু জবাই নয়,
বরং প্রতিদিন নিজের অহংকারকে কেটে ফেলা,
লোভের পশুকে জবাই করা,
অহংকারের গলায় ছুরি চালানো,
অন্তরের রক্তপিপাসু জানোয়ারকে বন্দি করে ফেলা।
বন্ধুগণ,
কুরবানি এক প্রতীক,
ইব্রাহিম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ) এর আত্মসমর্পণের অনন্ত স্মৃতি।
পিতা যখন ছেলেকে শুইয়ে দেন,
ছেলে যখন বলে—“আব্বা! আপনি আদেশ পালন করুন”—
এই ছিল ঈমানের চূড়ান্ত পরীক্ষা।
আল-কুরআন বলে:
“তাঁরা দুজন যখন আদেশ মান্য করলেন,
তখন আমি বললাম—‘হে ইব্রাহিম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্য করেছ।’”
(সূরা আস-সাফফাত: ১০৩–১০৫)
বন্ধুগণ,
এই আয়াতে কোনো গল্প নেই, আছে এক ভয়াবহ চেতনা।
যে বাবার চোখের মণিকে নিজ হাতে শুইয়ে দেন মাটিতে,
সে কেবল ছুরি হাতে নেননি, নিজেকে সঁপে দিয়েছেন আল্লাহর বিধানের কাছে।
কিন্তু আমরা?
আমরা পশু কাটলেও আমাদের আত্মা রয়ে যায় পরিবর্তনহীন,
পাপাচারে ভরা মন, হিংসা-বিদ্ধ অহংকার নিবদ্ধ।
বন্ধুগণ,
আল্লাহর কাছে রক্ত মাংস নয়, তার কাছে পৌছে তাকওয়া ।
এই সত্য বুঝলে কুরবানি হয়ে ওঠে হৃদয়ের বিপ্লব।
আল-কুরআন বলে:
“আল্লাহর কাছে পশুর মাংস বা রক্ত পৌঁছে না,
পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া।”
(সূরা হজ্জ: ৩৭)
তোমার গরু কত টাকায় কেনা,
তোমার গরু কত বড়, তোমার গরু কত মোটা—এই হলো আমাদের আলোচনার বিষয়!
কিন্তু আল্লাহ জিজ্ঞাসা করেননি তোমার পশুর দাম,
তিনি প্রশ্ন করেন—তুমি কেমন বান্দা?
তোমার অন্তরে কেমন তাকওয়া?
তুমি পশু জবাই করেছো ঠিকই,
কিন্তু তোমার ভেতরের অহংকার কি আজও জীবিত?
বন্ধুরা,
ইব্রাহিমের কুরবানি এক “স্পষ্ট পরীক্ষা”—এ কথা কুরআন নিজেই বলেছে।
আল-কুরআন বলে:
“এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা।”
(সূরা আস-সাফফাত: ১০৬)
কিন্তু আজকের কুরবানি কি পরীক্ষা নয়?
আজও তো আমাদের পরীক্ষা হয়—
কার মাংস কে বেশি রেখেছে,
কে কয়জনকে দাওয়াত দিয়েছে,
কে কোরবানি দিয়ে বেশি ছবি আপলোড করেছে।
এই কি কুরবানি?
আল্লাহ বলেন,
যে কোরবানি তাকওয়ার শিখরে পৌঁছায় না,
তা তাঁর দরবারে অগ্রহণযোগ্য।
বন্ধুগণ,
কুরবানি মানুষকে মানুষ বানায়।
সে শেখায়—তুমি একা খাওয়ার জন্য পশু জবাই করো না,
তুমি কোরবানি করো গরীবের মুখে মাংস তুলে দিতে।
আল-কুরআন বলে:
“তারা আল্লাহর ভালোবাসায় খাদ্য দান করে—
মিসকিন, এতিম ও বন্দীদের।”
(সূরা আল-ইনসান: ৮)
কিন্তু আজ?
আমরা তো ফ্রিজ ভরতে কোরবানি করি।
যার বাড়ি তিনতলায়, সে নিচতলার গরীব প্রতিবেশীকেও দেয় না।
মাংস নিয়ে হুল্লোড় হয়, রেস্তোরাঁর রকমারি রান্না হয়—
কিন্তু গরীব শিশুদের মুখে কি হাসি ফুটে?
বন্ধুগণ,
এই কোরবানি আল্লাহর সন্তুষ্টি আনে না,
এ কেবল অন্তরের পশুত্বকে আরও মোটা করে তোলে।
কুরবানি মানে নিজেকে আল্লাহর বিধানের কাছে সম্পূর্ণ সঁপে দেওয়া।
আল-কুরআনের সামষ্টিক শিক্ষা:
“যারা আল্লাহর পথে রক্ত দেয়, তাদের সম্মান বৃথা যায় না।”
এই কথা শুধু রণাঙ্গনের জন্য নয়।
যখন তুমি নিজের লোভ কাটো,
নিজের হিংসা কোরবানি দাও,
নিজের ভালোবাসার জিনিস আল্লাহর নামে ত্যাগ করো—
তখনও তুমি আল্লাহর রাস্তায় রক্ত দাও।
বন্ধুগণ,
এই রক্ত জমাট বাঁধে না,
বরং আল্লাহর আরশে যায়।
এই রক্তের সৌরভে ফেরেশতারা গর্ব করে,
আর এই ইখলাসে বান্দা হয় ‘মুকাররাব’।
আসুন, এবার সত্যিকার কুরবানি দেই—
জবাই করি নিজেদের কৃপণতা,
ছুরি চালাই অহংকারের গলায়,
রক্ত ঝরাই কুপ্রবৃত্তির, লালসার, হিংসার।
আসুন,
আমরা আল্লাহকে বলি—
“হে রব! গরু তো কেটেছি বহুবার,
এবার নিজের অন্তর কাটি তোমার নামে,
তুমি গ্রহণ করো এই নতুন কুরবানি।”
বন্ধুগণ,
তোমরা যাদের দেখো পশু কাটতে, কিন্তু মানুষের মতো আচরণ করতে পারে না,
তারা কেবল রীতির অনুসারী, দ্বীনের নয়।
আসুন, আমরা রীতিকে নয়, রূহকে বাঁচাই—
আচার নয়, ইখলাসকে মূল্য দিই।
এই কুরবানির ঈদে প্রতিটি ছুরি হোক একেকটি তাকওয়ার সোপান,
প্রতিটি পশু হোক আত্মশুদ্ধির প্রতীক,
প্রতিটি রক্তকণা হোক বান্দার আল্লাহর পথে ফেরা।
কুরবানির এই মাহে জিলহজে
তুমি যদি কেবল পশু কেটে খুশি হও—
তবে তুমি কেবল মাংস পেয়েছো,
আল্লাহকে পাওনি।
কিন্তু যদি তুমি আল্লাহকে পাওয়ার নিয়তে,
একটি ত্যাগী অন্তর নিয়ে এগিয়ে যাও—
তবে কুরবানির মাধ্যমে তুমি ফিরে পাবে সেই ইব্রাহিমী চেতনা,
যা পাহাড় ভেদ করে আকাশ ছুঁয়েছিল,
যা ছেলের গলায় ছুরি চালিয়ে চোখে অশ্রু নয়—সন্তুষ্টির হাসি ফুটিয়েছিল।
বন্ধুগণ, এবার বলো—তোমার কুরবানি আসলেই কিসের?
গরুর মাংসের, না আত্মার পরিশুদ্ধির?
ঈদের আনন্দে শুধু পেট ভরো না—
আত্মা ভরো তাকওয়া দিয়ে।
এই হোক তোমার আসল কুরবানি।
0 تعليقات