Subscribe Us

হাদিসের নামে জালিয়াতি

 হাদিসের নামে জালিয়াতি

হাদিসের ভিত্তিতে যেটাকে সুন্নত, মুস্তাহাব বা মাকরুহ বলা হচ্ছে ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে আবার সেটাকে ফরজ, ওয়াজিব বা হারামও বলা হচ্ছে। টিভিতে বা অনলাইনে যত মাসালা-মাসায়েলের অনুষ্ঠান দেখবেন, বেশির ভাগ মাসালার ভিত্তিই হচ্ছে হাদিস এবং ফিকহী বিশ্লেষণ। 

অতএব মানুষকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করো এবং আমার নিদর্শনগুলোকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করো না। যদি কেউ আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা দ্বারা বিচার করতে ব্যর্থ হয়, তারা অবিশ্বাসী। (-কুরআন, আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী)

অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় কোরো না, আমাকে ভয় করো এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে সামান্য মূল্য ক্রয় কোরো না। আর যারা আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তার মাধ্যমে ফয়সালা করে না, তারাই কাফির। (সূরা মায়েদা, আয়াত-৪৮)

Ads by Eonads

একই সূরার পরের আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, আর যারা আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তার মাধ্যমে ফয়সালা করে না, তারাই জালিম। (সূরা মায়েদা, আয়াত-৪৫)

অপর আয়াতে বলা হয়েছে, আর যারা আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তার মাধ্যমে ফয়সালা করে না, তারাই ফাসেক বা পাপিষ্ঠ। (সূরা মায়েদা, আয়াত-৪৭)

তিনটি আয়াতে উল্লেখিত 'ইয়াহকুম'-এর মূল শব্দ হুকুম অর্থাৎ হুকুম-আহকাম, বিধি-বিধান বা ফয়সালা হতে হবে আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তার ভিত্তিতে। নবীজি (সা.) অবশ্যই কুরআনের ভিত্তিতেই যাবতীয় করণীয়-বর্জনীয় বিধি-বিধান দিয়েছেন।

কিন্তু ইসলাম ধর্ম বলতে আমরা বেশির ভাগ মানুষ যা বুঝি ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব, মাকরুহ, হারাম-এক কথায় যাবতীয় প্রচলিত ও পরিচিত ধর্মীয় রীতি- রেওয়াজের বেশির ভাগেরই অন্যতম প্রধান ভিত্তি হচ্ছে কুরআন- বহির্ভূত হাদিস এবং ফিকহ। 

হাদিসের ভিত্তিতে যেটাকে সুন্নত, মুস্তাহাব বা মাকরুহ বলা হচ্ছে ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে আবার সেটাকে ফরজ, ওয়াজিব বা হারামও বলা হচ্ছে। টিভিতে বা অনলাইনে যত মাসালা-মাসায়েলের অনুষ্ঠান দেখবেন, বেশির ভাগ মাসালার ভিত্তিই হচ্ছে হাদিস এবং ফিকহী বিশ্লেষণ। 

সংবিধানের ধারা পড়ে শোনানোর মতো কুরআন থেকে একটু তেলাওয়াত করা হয় এরপরই হাদিস, তাফসির, স্কলাররা কী কী বলছেন এবং দিন শেষে সিদ্ধান্ত যা দাঁড়ায় তার সাথে কুরআনের কোনো সম্পর্ক নেই।

হাদিস বলতে বোঝাচ্ছি বোখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, বায়হাকি-এসব হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হাদিস এবং ফিকহ মানে ইমাম আবু হানিফা, শাফেয়ী, মালেক, আহমদ ইবনে হাম্বলের ফতোয়া বা মত। 

কিন্তু এসব হাদিস বা ফিকহর সিদ্ধান্ত পালনের বাধ্যবাধকতা কতটুকু? এসব হাদিস এবং ফিকহ গ্রন্থের স্বীকৃতি বা অনুমোদনের ভিত্তি কী?

হাদিস এবং ফিকহ আমাদের রিলিজিয়াস মাইন্ডসেটের এত ইস্পাতকঠিন অংশ যে এর বাইরে ধর্মকে কল্পনা করা অসম্ভব। আমি সম্ভাব্য সব দিক থেকেই বিশ্লেষণ করব, যাতে আমরা একটা সার্বিক ধারণা নিতে পারি।

ধর্মপ্রাণ, ধর্মবিমুখ বা ধর্মবিরোধী বেশির ভাগ মানুষ জানে না, সে ধর্মের যা মানছে, মানছে না বা সমালোচনা করছে তার ভিত্তি কী? সেটা কি আদৌ ধর্মের এই অংশ? আপনি আস্তিক, নাস্তিক, ধর্মপ্রাণ মুসলমান বা মাওলানা যে-ই হন, আলোচনা আপনার ইসলাম ধর্মের প্রচলিত রীতি-রেওয়াজ সম্পর্কে আজন্ম লালিত ধারণার আদ্যোপান্ত বদলে দিবে ইনশাআল্লাহ।

নাস্তিক সহকর্মী নোয়াহর সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে আমাদের মনোজগতে ধর্ম বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রভাব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। যেখানে সংকলিত, সংগৃহীত বা বর্ণিত হাদিস পালনের বাধ্যবাধকতা নিয়ে প্রশ্নবোধক আলোচনা করেছি। কারণ কুরআনই মুসলমানদের জন্য আল্লাহর সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ এবং অনুমোদিত জীবনবিধান।

 'কুরআনের সরল সৌন্দর্য' অধ্যায়ে কুরআনের আলোকে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছি। আমি বিশ্বাস করি ধর্মের নামে অধর্মের চর্চা বা দিনভর পণ্ডশ্রমের আগে গভীর মনোযোগ দিয়ে সবারই এই ধারণাগুলো নিশ্চিত হওয়া দরকার।

আমি ব্যক্তিগতভাবে ধর্ম নিয়ে কারো সাথে বিতর্ক করি না। হাদিস, ফিকহ, আলেম, স্কলার সবই মানি, তবে পরিমাণমতো মানি। নোয়াহর সাথে আমার কথোপকথনটা ডিবেট ছিল না। ছিল ডায়ালগ বা ডিসকাশন। ডিবেট মানে সেখানে জয়-পরাজয়ের একটা ব্যাপার থাকে। নিজের জানা বা বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা থাকে। ডায়ালগ বা ডিসকাশনের উদ্দেশ্য আরো ভালোভাবে বোঝা। যারা সত্য জানতে সচেষ্ট, পরিচিত বৃত্তের বাইরে ভাবতে প্রস্তুত, তাদের জন্য এ আলোচনা।

নবীজির সুন্নাহ বা কথা, কাজ, অনুমোদনের নিঃশর্ত অনুসরণ বাধ্যতামূলক তা কুরআনের বর্ণনায় স্পষ্ট এবং সর্বসম্মত।

কিন্তু নবীজির 'কথিত' সুন্নাহ অর্থাৎ বলা হচ্ছে যে নবীজি বলেছেন সেসব হাদিস অনুসরণের বাধ্যবাধকতা কতটুকু? এসব হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে নবীজির ইন্তেকালের কয়েকশ' বছর পর।

হাদিস নিয়ে প্রশ্নে প্রধান যে উত্তরগুলো পেয়েছি তা প্রধানত কুরআনে নবীজির জীবন ও কর্মের অনুসরণের নির্দেশ

👉  সূরা আল ইমরানের ৩২ নম্বর আয়াত- 

বল, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর। (অনুবাদ-মুফতি তাকী উসমানী)

"হে নবী আপনি বলুন- আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো।" 

👉 সূরা আল ইমরানের ৩১ নম্বর আয়াত-

বল, 'তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমাকে অনুসরণ কর।

"হে নবী! আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার অনুসরণ করো।" 

👉 সূরা আহযাব, আয়াত-২১

আপনার জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে একটি উত্তম আদর্শ রয়েছে - মুফতি তাকী উসমানী

অবশ্যই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।

👉 সুরা আল-আহযাব, আয়াত-৩৬

যখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাদের উদ্বেগজনক একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তখন কোন বিশ্বাসী পুরুষ বা মহিলার পক্ষে সেই বিষয়ে পছন্দের স্বাধীনতা দাবি করা সঙ্গত নয়: যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে অমান্য করে সে সুদূরপ্রসারী পথভ্রষ্ট।

আব্দুল হালিম, কোরান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস।

আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজেদের ব্যাপারে অন্য কিছু ইচ্ছা করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।

কুরআনে আরো অনেক আয়াতেই আল্লাহ ও তার রাসূলের নিঃশর্ত অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের নিঃশর্ত আনুগত্য আমাদের ঈমানের প্রধান ভিত্তি।

যে ক'টি আয়াত এখানে উল্লেখ করেছি তাতেই এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত এবং আমরা একমত যে নবীজির আনুগত্য এবং তাঁর সিরাত বা সুন্নতের অনুসরণ বাধ্যতামূলক। তাই একই ধরনের আয়াতের উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই।

"আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অমান্য করলে সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।" এখন আল্লাহর নির্দেশ কী? তা কোথায় লেখা আছে? কুরআনে। কুরআনের বাইরে আর কোনো কিছুকে আল্লাহর বাণী হিসেবে বিবেচনার সুযোগ আছে? নেই।

একইভাবে নবীজির সিরাত ও সুন্নতের নির্ভুল, নির্ভেজাল বিবরণ কেবল কুরআনেই আছে।

কুরআনে আল্লাহ 'আমি' না বলে 'আমরা' বলেছেন। এই 'আমরা' মানে আল্লাহ, জিব্রাইল (আ.) এবং আল্লাহর রাসূল (সা.)। আল্লাহ আমি না বলে আমরা বলেছেন। কারণ লিডার কখনো 'আই' বলে না, লিডার সব সময় বলে 'উই' এবং আল্লাহ যা বলেছেন জিব্রাইল (আ.) হুবহু তা-ই বলেছেন। 

এ জন্যই তাঁর উপাধি জিব্রাইল আমিন। একই কথা নবীজিও হুবহু মানুষকে জানিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর নির্দেশ এবং রাসূলের নির্দেশ একই। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মানে কুরআন।

আমরা হাদিস বা সুন্নত বলতে নবীজির কথা, কাজ এবং অনুমোদনকেই বুঝি। তো নবীজি কী বলেছেন? কী করেছেন? কী করতে নিষেধ করেছেন বা কী অনুমোদন দিয়েছেন?

আল্লাহ নবীকে যা বলতে বলেছেন, যা করতে বলেছেন বা যা করতে নিষেধ করেছেন, তাই না?

সূরা আল ইমরানের এই দুটি আয়াতের শুরুতেই 'কুল' শব্দটি আছে, যার অর্থ বলুন অর্থাৎ আল্লাহ নবীকে বলেছেন- "হে নবী, আপনি বলুন'; কুরআনে এমন শত শত আয়াত আছে যেখানে আল্লাহ নবীকে বলতে বলেছেন, তেলাওয়াত করতে বলেছেন, আদেশ করতে বা নিষেধ করতে বলেছেন।

শুধু কুল শব্দটিই কতগুলো আয়াতের শুরুতে এসেছে-ধারণা করতে পারেন? ৩৩২টি আয়াতের শুরুতে এবং এর অনেক ক্ষেত্রেই পরের আয়াতগুলোও আগের আয়াতেরই ধারাবাহিকতা। কুরআনে সহস্রাধিক আয়াত আছে, যাতে

আল্লাহ নবীজিকে বলেছেন- হে নবী! আপনি বলুন, আপনি জানিয়ে দিন, আপনি পড়ুন, আপনি করুন, আপনি করবেন না। আপনার জন্য এটা করা উচিত হবে না, আপনার জন্য এটা করা পাপ হবে না। এ বিধান একমাত্র আপনার জন্য মুমিনদের অন্যান্যদের জন্য নয়।

অর্থাৎ নবীজির অতিব্যক্তিগত, পারিবারিক বিষয়াদি থেকে শুরু করে সকল কথা-কাজ অনুমোদনের সুস্পষ্ট বিবরণী কুরআনেই আছে।

এখন কুরআনের বাইরে কি নবীজি আর কিছু বলেননি? বলেছেন। কিন্তু সেসব আমরা কীভাবে জানব? কেন জানবো?

প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক নির্বাহী আদেশ অবশ্যই আইন কিন্তু প্রেসিডেন্ট যত কথা বলেন সব নির্বাহী আদেশ নয়।

আল্লাহর নির্দেশে নবীজি যত এক্সিকিউটিভ অর্ডার দিয়েছেন তার খতিয়ান কুরআনে আছে। এর বাইরে নবীজির বেডরুমে, বাথরুমে সিসি ক্যামেরা লাগানোর অনুমতি কে দিল? বাথরুম সিস্টেম রি- ইনভেন্ট করার জন্য আল্লাহ নবীজিকে পাঠাননি। জঙ্গলের পশু-পাখিকেও এসব শেখাতে হয় না।


আল্লাহ নবীজিকে যা শিক্ষা দিতে পাঠিয়েছেন সেসব কুরআনজুড়ে আল্লাহ নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন আপনি এটা করুন, আপনি এটা করবেন না।

যেমন-

আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না।

আপনি অভাবগ্রস্ত বা সাহায্যপ্রার্থীকে ধমক দিবেন না।

আর আপনি আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহ বর্ণনা করুন।

এমন করেন, করবেন না-অনেক অনেক উদাহরণ কুরআনে পাবেন। সুতরাং নবীজির কথা, কাজ অনুমোদনের স্পষ্ট বিবরণ কুরআনেই আছে।

সূরা আহযাব, আয়াত-২

তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয় তার অনুসরণ কর। তাফহীম-উল-কুরআন আবুল আলা মওদুদী

আর তোমার রবের কাছ থেকে তোমার প্রতি যা ওহি করা হয় তুমি তার অনুসরণ কর।

আল্লাহ আমাদেরকে নবীজির অনুসরণ করতে বলেছেন। কারণ নবীজিকেও আল্লাহ যে ওহি দিয়েছেন তার অনুসরণ করতে বলেছেন।

একটা সহজ উদাহরণ দেই-

কূটনৈতিক আইন অনুযায়ী একজন রাষ্ট্রদূত সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি। তার (আনুষ্ঠানিক) বক্তব্য, বিবৃতি সে দেশের প্রেসিডেন্টের বক্তব্য বলে বিবেচিত হবে এবং প্রেসিডেন্টের জন্য প্রযোজ্য সকল রাষ্ট্রীয় প্রটোকল রাষ্ট্রদূতের জন্য প্রযোজ্য। 

রাষ্ট্রদূতকে লালগালিচা সংবর্ধনা দিতে হবে, গার্ড অব অনার দিতে হবে। রাষ্ট্রদূতের নামের আগে "Your Excellency" (রানির প্রতিনিধি হলে Your Majesty) বা মহামান্য বলতে হবে। রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে জাতীয় পতাকা থাকবে, সে গাড়ি কোনো দেশের ট্রাফিক পুলিশ থামাতে পারবে না। 

রাষ্ট্রদূতের জন্য কোনো ফৌজদারি বা শুল্ক আইন প্রযোজ্য নয়। রাষ্ট্রদূতকে কোনো অবস্থাতেই গ্রেফতার করা যাবে না, তার বাড়ি, গাড়ি বা লাগেজ তল্লাশি করা যাবে না। কারণ তিনি প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি। এখন রাষ্ট্রদূতের এত এত মর্যাদা শুনে আপনার মনে হচ্ছে, আহ, যদি রাষ্ট্রদূত হতে পারতাম। রাষ্ট্রদূতের দায়বদ্ধতা শুনলে বলবেন, ভাই! থাক, বহুত আরামে আছি। 

স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যা লিখে দিবে এর বাইরে একটা দাড়ি- কমাও যোগ করতে পারবেন না। রাষ্ট্রদূতের কথা আক্ষরিক অর্থেই রাষ্ট্রপ্রধানের কথা। ওয়াশিংটনের সংবাদ সম্মেলনে উপজাতি বলতে গিয়ে যদি আদিবাসী বলেন তো সর্বনাশ। আমাদের দেশের সরকার উপজাতিদের আদিবাসী বলে মেনে নেয় না কিন্তু উপজাতিরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দেয়। 

তাই রাষ্ট্রদূতের মুখে উপজাতি এবং আদিবাসীর মধ্যে অনেক পার্থক্য কিন্তু মেহেদী হাসান নামে জনৈক ব্যক্তি আমি রাষ্ট্রদূতকে বলতে শুনেছি বললে সেটা প্রেসিডেন্টের কথা বা রাষ্ট্রদূতের কথা বলে বিবেচিত হবে? সে কথার ওপর ভিত্তি করে বোমা মেরে দেয়া যাবে? কোনো পত্রিকা সেই মেহেদী হাসানের বরাত দিয়ে রিপোর্ট করলে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে? মেহেদী হাসান আবার কে?

রাষ্ট্রদূতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

তো রাষ্ট্রদূত তার বন্ধুর সাথে কোনো কথা বললে সেটা কি Official বিবৃতি?

তাহলে তাদের বর্ণিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অনেক ফরজ, ওয়াজিব বা হারাম প্রচলিত, যা কুরআনে ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ নেই। এমনকি লক্ষ লক্ষ সাহাবি, তাবেয়ী এবং তাবে তাবেয়ীনদের কথা, কাজ অনুমোদনও হাদিস।

বাংলাদেশে আহলে হাদিসের সবচেয়ে বড় আলেমদের একজন শেখ আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ বলছেন, প্রায় তিন লাখ জাল হাদিস আছে। হাদিসের প্রয়াত অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের বই হাদিসের নামে জালিয়াতি পড়তে পারেন। কত কত জাল হাদিস সমাজে প্রচলিত একটা ধারণা পাবেন। 

স্বদেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়লে ৮০ হোকবা দোজখের আগুনে পুড়তে হবে। এমন অনেক বহুল প্রচলিত হাদিস জাল। নবীজির পথে কাঁটা দেয়া বুড়ির গল্পকে আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ সম্পূর্ণ বানোয়াট গল্প বলেছেন। অথচ হজে গেলে আপনাকে সে বুড়ির বাড়িতে নিয়ে যাবে। হজে গেলে আপনাকে আরো আরো বহু কিছু দেখানো হবে। 


এখানে নবীজি জিনদের সাথে মিটিং করতেন, এটা নবীজির বাড়ি, এটা আবু জেহেলের বাড়ি কিন্তু সৌদি আরবের মানুষ এসব আজগুবি তথ্য জানে না। বিদায় হজের যে ভাষণকে হাদিসের আরেকটি বড় ভিত্তি হিসেবে মানা হয় সে বিদায় হজের ভাষণই হাদিসের ঢেঁকি গেলার বিপত্তির সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মুসলিম বিশ্বের প্রধান বিভাজন শিয়া-সুন্নি বিভক্তির উৎস এই বিদায় হজের ভাষণ। 

সে বিভাজনের ঐতিহাসিক বাস্তবতা সম্পর্কে পরবর্তীতে আরো আলোচনা করব। হাদিসশাস্ত্র অনুযায়ী বিখ্যাত বিশ্বস্ত কয়েকজন সাহাবি একটা হাদিস বর্ণনা করলে সেটা মুতাওয়াতির বা সন্দেহাতীতভাবে পালনীয় সহিহ হাদিস। বিদায় হজের বিখ্যাত ভাষণে নবীজির প্রধান-অপ্রধানসহ লক্ষাধিক সাহাবি ছিলেন। সুতরাং এ নিয়ে কোনো সন্দেহ, সংশয় বা দ্বিমত থাকার সুযোগ নেই। 

আমরাও সারা জীবন এমনটা জেনে এবং মেনে আসছি যে বিদায় হজের ভাষণ ইউনিভার্সাল। কিন্তু শিয়াদের একাংশ মনে করে নবীজি বিদায় হজে বিশেষ কোনো ভাষণ দেননি। কিন্তু সকল সাহাবিকে নিয়ে বিদায় হজ থেকে ফেরার পথে 'গাদিরে খুম' নামক স্থানে যাত্রা বিরতির নির্দেশ দেন এবং সেখানে তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যেখানে লক্ষাধিক সাহাবির উপস্থিতিতে হজরত আলী (রা.)-কে তাঁর পরবর্তীতে মুসলিম বিশ্বের অভিভাবক (মাওলা) হিসেবে ঘোষণা দেন এবং হজরত আবু বকর, ওমর, ওসমান (রা.)-সহ সকল সাহাবি হজরত আলীর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। কিন্তু এত বড় ঘটনা আমরা সুন্নিরা জানি না।

আমরা জানি নবীজি (সা.) বলেছেন আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, একটি কুরআন আর আরেকটি আমার সুন্নাহ। কিন্তু তেহরান ইউনিভার্সিটির হাদিসের অধ্যাপকরা জানেন নবীজি কুরআন এবং আহলে বাইত বলেছেন। 

এ কারণেই হজরত আলী, ফাতেমা, হাসান, হোসাইন (রা.)-সহ নবী-পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কারো হাদিস তারা গ্রহণ করে না। এমনকি আহলে বাইতের নিঃশর্ত অনুসরণকে তারা ঈমানের অংশ মনে করে। অর্থাৎ কালেমার সাথে আলী অলিউল্লাহ না বললে কেউ মুসলমান হতে পারবে না।

নবীজির প্রায় সকল সাহাবি যেখানে উপস্থিত ছিলেন সেখানে বিদায় হজের ভাষণ না গাদিরে ঘুমের ভাষণ, নবীর সুন্নাহ না আহলে বাইত-এ বিষয়ে মুসলিম জাহান একমত হতে পারেনি।

শিয়াদের মধ্যেও ইসমাইলি, হোসাইনিয়া, টুয়েলভার্স বহু ভার্সন আছে। আমাদের সুন্নিদের মধ্যেও অনেক শিয়া বিশ্বাস আছে, আমরা জানিও না। কারণ আমাদের অঞ্চলে শিয়ারা ধর্ম প্রচার করে তাদের শিয়া পরিচয় গোপন রেখে। আমাদের অনেক নবাবরাও শিয়া ছিলেন। 

আমাদের দেশে খুব কমন নাম ফাতেমা, আলী, হাসান, হোসাইন। অনেকের নামের শেষে এ নামগুলো থাকে মোহাম্মদ আলী, আনোয়ার হোসাইন বা আলী হোসেন। এ নামগুলো সৌদি আরব গিয়ে বললে ওরা ধরে নিবে শিয়া। এমনকি ইমাম মাহদীর ধারণা আমাদের মধ্যে ছড়িয়েছে শিয়ারা। তারা যে ১২ জন ইমামে বিশ্বাস করে তার শেষজন হবেন ইমাম মাহদি। কুরআনে এর কোনো ইঙ্গিত নেই।

সুন্নিদের মধ্যেও সুফি, তরিকতপন্থীরা গাদিরে খুম, মাওলা আলীসহ অধিকাংশ শিয়া বিশ্বাস পোষণ করে।

শিয়া-সুন্নি মুসলিম বিশ্বের প্রধান দুটি দল। ইরাক, ইরান, ইয়েমেন, তুরস্ক, সব দেশেই উল্লেখযোগ্য হারে শিয়া আছে; তেহরান ইউনিভার্সিটিসহ তাদের বহু বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ইউরোপ-আমেরিকান ইউনিভার্সিটিগুলোতে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে শিয়া এবং সুন্নিজম সমান গুরুত্ব দিয়েই পড়ানো হয়। 

কিন্তু শিয়া- সুন্নিদের মধ্যে কাদের হাদিস সহিহ এটা এত এত উচ্চতর গবেষণা করেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি নবীজি আহলে বাইত না তাঁর সুন্নাহ অনুসরণের কথা বলেছেন। এর চেয়ে ছোট ছোট বিষয় যেগুলো নিয়ে হাঁটে- মাঠে ঝগড়া চলছে সেগুলো নবীজি বলেছেন কীভাবে নিশ্চিত হব?

এই অমুকের কাছ থেকে তমুকে শুনছে এই গুজবকে অনুমোদন দিয়ে শুধু শিয়া- সুন্নিতেই শেষ নয়। বলা হয় 'এক লেপের নিচে দুই মৌলভী ঘুমাতে পারে না কারণ লেপের মসলা নিয়ে ঝগড়া লেগে শেষে লেপে আগুন লাগিয়ে দিবে। জ্ঞান অর্জনের জন্য চীন দেশে যাও। জ্ঞানীর কলমের কালি শহিদের রক্তের চেয়ে পবিত্র, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। এমন বিখ্যাত হাদিসকে অনেক মুহাদ্দিস বলছেন জাল।


হাদিসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে বড় বড় মুহাদ্দিস মুফতিদেরই গলদঘর্ম অবস্থা। যে হানাফি, মালেকী, শাফেয়ী, হাম্বলী এত এত মাজহাব, উপমাজহাব, তরিকা, ফেরকা- এর ভিত্তি কী? যে হাদিসকে একজন সহিহ বলছেন আরেক ইমাম বা পীর সেটাকে জয়িফ বা জাল বলছেন। 

শুধু জাল হাদিসই যদি হয় তিন লাখ, তো এর ভেতর থেকে জয়িফ, হাসান, সহিহ হাদিস বের করা কেমন কঠিন ব্যাপার? আর এত এত জাল হাদিস কারা তৈরি করল? কেন করল? এসব হাদিসের ভিত্তিতে নতুন দল, উপদল তৈরি, নতুন নতুন রীতি-রেওয়াজ চালু, নতুন নতুন বিধি-নিষেধ আরোপ করে স্বতন্ত্র মাজহাব প্রবর্তন, নতুন নতুন তরিকা বা দরবার খুলে বসা নতুন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মতবাদ প্রবর্তন করা। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

যাদের তরিকার সপক্ষে কোনো হাদিসও কমন পড়েনি তারা অগত্যা জনৈক বাদশাহ, জনৈক বুজুর্গের বরাত দিয়ে বহুত ফায়দা হাসিলের নানান কিচ্ছা বানিয়ে নিয়েছেন, যদিও এই জনৈক বুজুর্গের কোনো নাম, ঠিকানা, পোস্টাল কোড, ফোন নম্বর কিছুই নেই।

আহলে হাদিসের লোকেরা ফিকহী জটিলতা বাদ দিতে মাজহাবের ইমামদের মত প্রত্যাখ্যান করছেন, তারা কেবল কুরআন ও হাদিস পালনের পক্ষপাতী। কিন্তু আহলে হাদিসের সবচেয়ে বড় তিনজন পণ্ডিত নাসিরুদ্দিন আলবানী, আব্দুল্লাহ ইবনে উসাইমিন, আব্দুল আজিজ ইবনে বাজ- এদের মধ্যে কমপক্ষে চারশ বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। এর কারণ কী? ওই যে হাদিস কোনটা সহিহ কোনটা জাল?

❤️

❤️

Post a Comment

0 Comments